শিরোনাম
◈ ইসরায়েল পাল্টা হামলা করলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জবাব দেবে ইরান: উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ মিয়ানমারের আরও ১০ সেনা সদস্য বিজিবির আশ্রয়ে ◈ সয়াবিনের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই: বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত বিএনপির ◈ কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকি, আইনের শাসনে জীবনযাপন করি: ড. ইউনূস ◈ মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে ঢাকা ফিরছিলেন রফিক, পথে প্রাণ গেল সবার ◈ স্থায়ী জামিন না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছি: ড. ইউনূসের আইনজীবী ◈ উপজেলার ভোটে এমপি-মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপ না করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ : ওবায়দুল কাদের  ◈ শ্রম আইন লঙ্ঘন: ড. ইউনূসসহ ৪ জনের জামিন ২৩ মে পর্যন্ত বৃদ্ধি ◈ ময়মনসিংহে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ২৬

প্রকাশিত : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ০১:১১ রাত
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ০১:১১ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

পড়ার ক্ষুধা থাকলেও বই কেনার ক্ষমতা ছিলো না

রাফী হক

যে কবি আমার স্কুল জীবনে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলো তার নাম : সুকান্ত ভট্টাচার্য্য। স্কুলে বয়স্কাউট করতাম ফলে একসময় নজরুলে আচ্ছন্ন হলাম। কিন্তু মনের ভেতর সুকান্ত, তার কারণও ছিলো। তখন শোষণ-বঞ্চনা, মার্কসবাদী-চেতনা এসব বুঝতাম না। কিন্তু সুকান্তের ওই কবিতাটি : ‘যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ রাত্রে / তার মুখে খবর পেলুম : সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক, / নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার / জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে...’। জীবনে প্রথম অন্য রকম কবিতা পড়লাম। মনে হলো এ তো আমার কথা। আর কবিতায় কোনো অন্তঃমিলের কোনো বালাই নেই। এমন করে মুখের কথার মতো কবিতাও লেখা যায়, বেশ তো !
আমার পড়ার ক্ষুধা ছিলো প্রবল। বই কেনার ক্ষমতা ছিলো না। ক্লাস নাইনে ওঠে পাবলিক লাইব্রেরিতে যাওয়ার সুযোগ মিললো। পাবলিক লাইব্রেরিতে গদ্যই পড়তাম বেশি। লাইব্রেরিতে কবিতা বই রাখা থাকতো আলাদা করে, আলাদা আলমারিতে। খুব বেশি যে কবিতার বই ছিলো, তেমন না। একদিন দেখলাম জীবনানন্দ দাশ নামের একজন কবির কবিতার বই। এর আগে এই নামে কোনো কবির নাম শুনিনি, পাঠ তো দূরে থাক। যদিও জীবনানন্দ দাশ নজরুলের সমবয়স্ক ছিলেন, তবুও তিনি অজ্ঞাত ছিলেন আমার কাছে।
আর আমাদের পরিবারেরও কবিতা বা শিল্পের কোনো আবহাওয়া ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের পর পর বিধ্বস্ত একটি পরিবার। গ্রাসাচ্ছাদনের চিন্তায় মা-বাবা ব্যতিব্যস্ত। এর মধ্যে কবিতা, শিল্প, সাহিত্যের স্থান কোথায়? তবে আমার এক ছোট খালা ছিলেন, আম্মার ফুফাতো বোন। তিনি কবিতা পাগল ছিলেন। গান পাগল ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। কী সুন্দর করে তিনি শেষের কবিতা আবৃত্তি করতেন। ভাবতেনও, তিনিই শেষের কবিতার লাবণ্য। তিনি আমার বেবী খালা। একবার বলেছিলেন, ‘শোন, তুই আমাকে ‘লাবাণ্য খালা’ বলে ডাকবি তো, ঠিক আছে? কী বেবীখালা বেবীখালা করিস..!’ কিছুক্ষণ পরেই বলেছিলেন, ‘লাবণ্য খালা’ হয় না, লাবণ্যের পরে ‘খালা’... না থাক আমি তোর বেবী খালাই’...। তিনি আমার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভাব ঢুকিয়ে দিলেন। কেন যেন মনে করেছিলেন, আমার মধ্যে এক আবৃত্তিকার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে এবং সেই সম্ভাবনা সত্যি তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন। আমাকে বেশ কয়েকটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ করিয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর পর আমি যখন কুষ্টিয়া গভর্মেন্ট কলেজে পড়ি, তখন কলেজ ফাংশনে মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম। একবার কবিতা আবৃত্তি করে ফার্স্ট হয়ে পুরস্কারও পেয়েছিলাম। আমি তখন ছোটমোটো বাবু বাবু ধরনের বালক বালক দেখতে ছিলাম এ রকমের একটা গুটগুটে বালক মঞ্চে ওঠে লম্বা কবিতা চোখ বন্ধ করে বলে যাচ্ছে, এতেই বেশ হাততালি পেতাম।
যা বলছিলাম, জীবনানন্দের কথা। পাবলিক লাইব্রেরিতে জীবনানন্দের কবিতার বইটি আমার এতো ভালো লেগে গেলো কেন জানি না। মনে হলো, কিছু একটা পেয়েছি, হীরের খনির মতো কিছু : ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ / খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে / চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে / ভোরের দোয়েল পাখি- চারিদিকে চেয়ে দেখি পপ্লবের স্তূপ / জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশ্বত্থের করে আছে চুপ...’। তখন এতোটাই জীবনানন্দ আচ্ছন্ন ছিলাম যে আপন মনেই বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ার মতো তার কবিতা পড়তাম। কোথাও যাচ্ছি ট্রেনে চেপে, জীবনানন্দ পড়ছি। কোথাও দাঁড়িয়ে আছি, অপেক্ষা করছি কারু জন্য, জীবনানন্দ পড়ছি। সব মুখস্থ করে ফেলেছি। ওই সময়ে জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করেছি পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে কোনো সাহিত্যানুষ্ঠানে। তার কবিতা আবৃত্তি করে পুরস্কারও পেয়েছি। পুরস্কার ছিলো টেবিল ল্যাম্প। দেয়াল পত্রিকায় ফার্স্ট হয়েও টেবিল ল্যাম্প পেয়েছিলাম! মনে পড়ে, তখন আমি চার/পাঁচটি টেবিল ল্যাম্প পেয়েছিলাম! কী জানি তখন পুরস্কার হিসেবে টেবিল ল্যাম্প দেয়া হতো কেন? এই বস্তুটি সস্তা ছিলো কী? নাকি আলোর সিম্বল হিসেবে দেয়া হতো? আমাদের বাড়িতে তখন ইলেকট্রিসিটিও ছিলো না!
তখনও আমি নিজে কবিতা বা ছড়া লিখবো কল্পনাই করিনি। আমার উচ্চাকাক্সক্ষা একটিই ছিলো শিল্পী হবো। তারও আগে ছিলো পোস্টম্যান হওয়া। কারণ চিঠি আমার কাছে খুব রহস্যের মনে হতো, আনন্দের মনে হতো। আরেকটি কারণ হতে পারে, বেবী খালার সৌজন্যে আমি রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র, চিঠিপত্র ওই বয়সেই পড়ে ফেলেছিলাম। একটি চিঠির জন্য কতো মানুষের কতো ব্যাকুলতা, অপেক্ষা, প্রতীক্ষা! সত্যি বলতে আমি বড় বড় কোনো স্বপ্নই দেখিনি। আমার স্কুল বন্ধুদের মধ্যে সরওয়ার মুর্শেদ রতন ছিলো একমাত্র চৌকস ছেলে, কবিতা লিখতো, গল্প লিখতো, আবৃত্তি করতো, গান গাইতো। বলতে গেলে ওর অনুসরণেই প্রথম কবিতা লিখতে, গল্প লিখতে শুরু করি। সেইসঙ্গে শুরু হয় জীবনের নতুন স্বপ্ন। কিন্তু আকাক্সক্ষা একটিই তাহলো শিল্পী হওয়া।
আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে, বহু পরে যখন মার্স্টাসের ছাত্র তখন কিবরিয়া স্যার জীবনানন্দ দাশের কথা মাঝে মাঝে বলতেন। টুকরো টুকরো কথা। তার কবিতার কথা। তার কষ্টকর বেদনাময় জীবনের কথা। বিশেষ করে আমি যখন তার অধীনে থিসিস করছি তখন তিনি জীবনানন্দে নিবিড় হতে চাইতেন। আমি যখন চারুকলার স্টুডিওতে নিজের কাজে মগ্ন থাকতাম তখনও তিনি বলতেন, ওর কবিতা পড়বে।
আরও পরে, সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলাম কর্মসূত্রে। তিনি আমাকে প্রায় প্রতিদিনই জীবনানন্দের পাঠ দিতেন। হাসনাত ভাই খুবই স্বল্পভাষী। কিন্তু এই মানুষটি আদ্যোপান্ত একজন জীবনানন্দ। আমার জীবনে সেসব দিনগুলো খুব অন্য রকম, কিবরিয়া স্যারের পেইন্টিং নিয়ে কথা হচ্ছে অনিবার্যভাবেই জীবনানন্দ উপস্থিত। হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে নৌভ্রমণে বা স্টিমারে কোথাও যাচ্ছি, আমরা নদীর মধ্যে জীবনানন্দ দাশ নিয়ে কথা বলছি। অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, হাসনাত ভাই, কিবরিয়া স্যার, এই সময়টি খুব অনুভব করি।
জীবনানন্দ দাশকে যে বুঝি তা নয়। আমি জানি, একটি কবিতার সব ক’টি পঙক্তি কিংবা শব্দের পারম্পর্য মিলিয়ে একটি অর্থ খোঁজার চেষ্টা এক ধরনের পাগলামি। এর কোনো অর্থও হয় না। পেইন্টিংও তাই। রঙের পারম্পর্য বা রেখার সূত্র ধরে পেইন্টিং বোঝার বা অর্থ খোঁজাও একরকমের ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছু নয়। জীবনানন্দ তো ঠিকই বলেছেন, ‘কবিতা কী? কবিতা অনেক রকম’। ১৭ ফেব্রুয়ারি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন। তার জন্মদিনে আমার শ্রদার্ঘ্য। ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়