বিভুরঞ্জন সরকার : প্রায় তিন দশক পর আগামী ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন সরগরম । ক্যাম্পাসে সক্রিয় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনও তৎপর হয়ে উঠেছে। বিএনপি সমর্থক ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্র দল ক্যাম্পাসে সহাবস্থানের দাবি জানিয়ে আসছিলো। তাদের দাবি পূরণ হয়েছে। এক দশক পর ছাত্র দল মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সময় কাটিয়েছে। ক্যাম্পাসে ছাত্র দলকে স্বাগত জানিয়েছে ছাত্রলীগ। এটা একটি বিরল ঘটনা। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের ছাত্র রাজনীতি, ছাত্র আন্দোলন পুরনো ঐতিহ্যের ধারায় যদি ফিরতে পারে তাহলে সেটি হবে একটি বড় অর্জন।
তরুণদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ-উৎসাহ কম বলে শোনা যায়। বিদ্যমান রাজনীতি নিয়ে, দেশ পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে, প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক মানসিকতা নিয়ে তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ আছে। তবে এটাও ঠিক যে, অপরাধমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা তরুণদের মধ্যে এখনও প্রবলভাবেই আছে বলে মনে হয়। তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা, মানুষের জন্য কিছু করার মনোভাব জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে ডাকসু। বিভিন্ন জনহিতকর, কল্যাণকর কাজের সঙ্গে তরুণদের ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিতে পারে ডাকসু।
দেশের রাজনীতির ঐতিহ্য, রাজনীতির দীর্ঘ ধারাবাহিক ইতিহাসটাও নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরার উদ্যোগও ছাত্রদের নির্বাচিত সংস্থা হিসেবে ডাকসু নিতে পারে। ক্রমাগত বিকৃত প্রচার-প্রচারণার ফলে অনেকের মধ্যেই স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি আছে। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রথম সরকারের কাজকর্ম নিয়ে যেমন স্বচ্ছ ধারণার অভাব আছে, তেমনি পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতি নিয়েও আছে ভ্রান্তি। বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা নিশ্চয়ই ছিলো, কিন্তু সেজন্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার মতো জঘন্য কাজ করে ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে কারা রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত ও লাভবান হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান প্রয়োজন।
জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একইধারা ও কৌশলে রাজনীতি করলেও তাদের দু’জনকে নিয়ে পাবলিক পারসেপশন বা গণধারণা দুই রকম তৈরি করে প্রকৃত অর্থে রাজনীতির কতো ক্ষতি করা হয়েছে, সে সম্পর্কেও শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধানী হওয়া প্রয়োজন।
এরশাদ অবশ্যই খারাপ মানুষ। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের সরকারকে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে অন্যায় ও অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন এরশাদ। তার শাসন আমলে দেশে অনেক দুর্নীতি হয়েছে। গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতার ওপর নির্মম নিষ্পেষণ চালানো হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে অনেককে। ক্ষমতায় থেকে কেনাবেচার রাজনীতি চালু করেছিলেন এরশাদ। ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা হয়েছে। এরশাদ একজন দুঃশাসক হিসেবেই পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, জিয়াউর রহমান কোন বিবেচনায় প্রশংসিত এবং নন্দিত? জিয়া কোন প্রক্রিয়ায় দেশের শাসন ক্ষমতা কব্জা করেছিলেন? তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক অসততার অভিযোগ হয়তো নেই। কিন্তু দেশের সব ধরনের রাজনৈতিক অসততার জনক তিনি। জিয়া স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের প্রবর্তক। তিনি দালাল আইন প্রত্যাহার করে রাজাকার-আলবদরদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কুখ্যাত গোলাম আযমকে দেশে ফিরে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়ে বিদেশে নিরাপদ জীবনযাপনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে তার প্রাণ রক্ষাকারী মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করে সেনাবাহিনীতে ও রাষ্ট্রক্ষমতায় নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের আয়োজন করে ভোট-দুর্নীতির সূচনা করেছিলেন। মেধাবী ছাত্রদের সমুদ্র বিহারে নিয়ে সুযোগসন্ধানী ও বিপথগামী করেছেন। ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। দল ভাঙার রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করেছেন। আরো কতো কী! জিয়ার জুতা পায়ে দিয়েই এরশাদ পথ চলেছেন। তারপরও জিয়া ও এরশাদের পৃথক মূল্যায়ন দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের বিভাজন তৈরি করেছে। এসব বিষয়গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে রাজনীতিতে সুস্থতা ফিরে আসা সহজ হবে না। তরুণ সমাজকে রাজনীতি সচেতন ও রাজনীতিমুখী করে তোলার ক্ষেত্রে ডাকসু একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এখন দেখার বিষয় আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে যারা বিজয়ী হবেন তারা পুরনো ব্যবস্থা, চিন্তাধারা, মনমানসিকতা বদলে ফেলার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন কিনা।
লেখক : গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়
আপনার মতামত লিখুন :