যুগান্তর : যে উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৫২ সালে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার জীবন দিয়েছিলেন, সেকি শুধু পাকিস্তানের কাছ থেকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য, নাকি বাঙালির জাতিরাষ্ট্রে বাংলা তার স্বমহিমা নিয়ে জাতির চেতনাকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করবে এবং বাংলা ভাষা হয়ে উঠবে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শ্রেষ্ঠ ভাষা, সে জন্য? এটা সত্যি, বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে তার নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত শহীদদের জীবনদান কি পূর্ণ হতে পারে?
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এবং ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, সে দেশে কেন সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে নতুন করে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য হাহাকার করতে হবে? কেন নতুন করে আদালতকে নির্দেশনা জারি করতে হবে? এর মাধ্যমে আমরা যে শহীদদের জীবনদান ও স্বাধীনতার চেতনাকেই ভূলুণ্ঠিত করছি, তা নিয়ে কি কারও মাথাব্যথা আছে?
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হল, বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার বদলে আমরা যেন জাতি হিসেবে তাকে বিকৃতির জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছি। ইংরেজি ভাষার ধরনে বাংলা ভাষা বলার প্রবণতা, যাকে বহুবার ‘বাংলিশ’ বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছে, তাতেও কারও টনক নড়েনি। বরং বাংলিশ ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা নিয়ে এক ধরনের ইয়ার্কি করার প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতর, সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলগুলোতে যেভাবে ভাষার ভুল প্রয়োগ, অপপ্রয়োগ এবং যার যেভাবে খুশি লেখার স্বৈরাচার চলছে, তাতে বাংলা ভাষা এখন হুমকির মুখে রয়েছে।
সরকার কর্তৃক সর্বক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির যে ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ ব্যবহারের নির্দেশ দান করা হয়েছিল, সেটা অনুসরণ করার তাগিদও কারও মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে নির্দেশিত অভিধানটির ছাপা বন্ধ করে ছাপা হয়েছে ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ নামে নতুন এক অভিধান, যেটি শুধু ভুলে ভর্তি নয়, অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিমূলক। ফলে সব ক্ষেত্রে এখন বিভ্রান্তিমূলক ও অশুদ্ধ বানানের ছড়াছড়ি চলছে। এটা রীতিমতো শহীদদের আত্মার সঙ্গে বেইমানির শামিল। বিকৃতি, বিভ্রান্তি এবং অশুদ্ধতার প্রয়োগে বাংলা ভাষার এখন নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।
এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে সরকারকেই শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। তা না হলে এই আত্মঘাতী ভূমিকার জন্য বাংলা ভাষা যেমন বিকৃতির গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না, তেমনি বিলুপ্তির ঝুঁকি নিয়ে শহীদদের জীবনদানকেও বৃথা করে তুলবে। এখন আমাদেরই ভেবে দেখতে হবে, আমরা কি সেই আত্মঘাতী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে সবাই মিলে এগিয়ে আসব; নাকি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাটিকে বিলুপ্তির সম্ভাবনার দিকে ঠেলে দেব?
আপনার মতামত লিখুন :