ড. এমদাদুল হক : বার্গার সভ্যতায় ভোজন এতোই বিকারগ্রস্ত যে, মানুষ এখন বিকারকেই কার ভাবছে। জীবন নির্ভর করে খাদ্যের ওপর, অথচ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা খাওয়া শেখায় না। স্কুলের সামনে বার্গার, ফুচকার দোকান। শিক্ষাবিদরা ধরেই নিয়েছেন যে, খাওয়া কাউকে শেখাতে হয় না। কোনো পাঠ্য বইতে ভোজন সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ পাওয়া যাবে না। এ কেমন জীবন বিচ্ছিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা?
ধর্ম, অর্থ নাকি ধারণ করা। মানুষ কী ধারণ করে? মানুষ তো ধারণ করে আহার। অথচ ‘আহার শৃঙ্খলা’ ধর্মীয় শিক্ষার অন্তর্গত নয়। এ কেমন ধারণ বিচ্ছিন্ন ধর্ম? স্কুলে মানুষ শিখে ধক্ষ্ম-নক্ষ্ম = (ধ-ন)(ধ+ন), আর বারডেমে গিয়ে শিখে ‘শৃঙ্খলাই জীবন’। মক্তবে শিখে- ‘তিন ব্যক্তির খাবারের কোনো হিসেব নেয়া হবে না ইনশাআল্লাহ- রোজাদার, সেহেরীর খাবার গ্রহণকারী এবং মোজাহিদ‘ (মুসনাদুল বাজ্জার)। আর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে গিয়ে শিখে- ‘পেটের এক তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচলের জন্য রেখে দেয়া উচিত’ (তিরমিজি)।
১০ শতাংশ মানুষ এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। পৃথিবীতে প্রতি ১০ সেকেন্ডে ১ জন ডায়াবেটিস রোগীর মৃত্যু হচ্ছে এবং প্রতি ১০ সেকেন্ডে ২ জন নতুন ডায়াবেটিস রোগী সনাক্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ-বিশৃঙ্খল জীবনযাপনের ফল। আধ্যাত্মিকতায় কি চলছে? আধ্যাত্মিক মানুষ সর্বাধিক সুশৃঙ্খল হওয়ার কথা, অথচ তারাই সর্বাধিক বিশৃঙ্খল। আশ্রমগুলোতে কিছুটা খাদ্য শৃঙ্খলা আছে বটে কিন্তু সুফি দরবারগুলোতে খাদ্যবিশৃঙ্খলা অতিশয়। দরবারগুলোর খাদ্য ব্যবস্থাপনা দেখলে মনে হয়, এগুলো যেন ‘ভোজন বিকার শিক্ষাশালা’।
মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যহানীর মূল কারণ ভোজন বিকার। ভোজন বিকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য অত্যাহার ও অত্যল্পাহার। দুটি ভোজন বিকার বিপরীত ধর্মী হলেও অন্তরালের কারণগুলো একই- বিষণতা, বিচ্ছিন্নতা, উদ্বেগ।
অত্যল্পাহারকে অনেকেই আধ্যাত্মিক উন্নতির লক্ষণ হিসেবে গণ্য করে, আসলে তা হলো ‘ভোজন বিকার’ রোগ। অত্যাল্পারে ওজন হ্রাস পায়; একা খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়; বিষণœতা ও বিচ্ছিন্নতা বোধ বৃদ্ধি পায়; কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়; রক্তচাপ, শ্বাস ও হৃদস্পন্দন কমে যায়; দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কমে যায়; আলস্য দেখা দেয়।
যে সব আধ্যাত্মিক গুরুরা ওজন কমিয়ে, রুগ্ন দেহ নিয়ে জ্ঞান লাভের তালিম দেয়, তারা আছে মহাবিভ্রান্তিতে। রোগা চেহারা জ্ঞানের উৎস হতে পারে না। শুকিয়ে যাওয়া- আধ্যাত্মিক উন্নতির স্মারক হতে পারে না। অত্যল্পাহারে আত্মোন্নতি হয় না- উৎপন্ন হয় হীনম্মন্যতা। এ ধরনের রোগীরা আত্মগ্লানিতে ভোগে এবং হুজরা খানায় বদ্ধ থেকে সাধনার ভান করে। আসলে তাদের বাইরে বের হওয়ার সক্ষমতা নেই।
অত্যল্পাহারের বিপরীতে রয়েছে অত্যাহার। গজন্দর পীরবর্গের সাগরেদরা গোসা করতে পারেন, কিন্তু সত্য হলো এই যে, স্থূলতা শুধু রোগ নয়- এটি সব রোগের কেন্দ্র। কীভাবে একজন সাধকের দেহ সব রোগের কেন্দ্র হতে পারে?
যারা আত্ম জাগরণের পথে যাত্রা করতে চায় তাদের এমন একটি সংবেদনশীল দেহ থাকা দরকার যা সূক্ষ্মতর কম্পনে সাড়া দিতে সক্ষম। আধ্যাত্মিক বিচারে নিঃসন্দেহে অত্যাহার মানুষকে নিষ্ঠুর করে তুলে; দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়গুলো আমির নির্দেশ বাস্তবায়নে অসমর্থ্য হয়ে উঠে; এবং সদুপদেশ শ্রবণে, গ্রহণে প্রদানে অনীহা উৎপন্ন হয়।
পাইকা রোগ মারাত্মক ভোজন বিকার। পাইকা রোগীরা এমন কিছু গিলে, যার ভিতর পুষ্টি নেই। যেমন- ইট, মাটি, বালি, পাথর, কাপড়, কাগজ ইত্যাদি। অজ্ঞ মানুষ পাইকা রোগীদেরও সাধক ভেবে পূজা দেয়! অবস্থা দৃষ্টে প্রতীত হয়, ধর্মান্ধতা বুঝি পাইকা রোগ থেকেও মারাত্মক ব্যাধি। ফেসবুক থেকে