অসীম সাহা : ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর বিএনপির তাণ্ডবের ভয়াবহতার কথা জানে তারা, যারা ক্ষতিগ্রস্ত। জানে মহিমা, শেফালী ও পূর্ণিমারা! জানে ৩০০০ মন্দিরের পূজারী ও সেবায়েতরা। জানে লক্ষ লক্ষ নিরীহ হিন্দুসম্পদায়ের লোকজন। সেই বিএনপির মুখে যখন হিন্দুসম্প্রদায়ের জন্য কিছু করার কথা শুনি, তখন আর কৌতুকবোধ করি না, লজ্জায় মুখ ঢাকতে ইচ্ছে করে। সমস্যা হলো, যারা বিএনপি করেন, তাদের কোনো মুখ নেই, আছে মুখোশ। সেই মুখোশের আড়ালে যে দানব বাস করে, তার সঙ্গে ফখরুল-রিজভী এন্ড গংদের মুখের খুব মিল! আর বাকি যারা আছেন, তারা ছাগলের ৩নং বাচ্চা। কাজের চেয়ে লাফায় বেশি। বিএনপিতে আবার দুদু-দুলুরা আছেন। মিচকে মানুষ ছিঁচকে চোরের মতো। দুদু তো চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন। তবে তিনি কথা বলেন যুক্তি দিয়ে। কী যুক্তি? নিজের কিছু ছ্যাচড়া যুক্তি। ‘খালি ঢাক বেশি বাজে’ কথাটা কি তা হলে দুদুর কথা মনে করেই আবিষ্কৃত হয়েছিলো? জানি না। আসলে বিএনপির বেশিরভাগ নেতকাই কথা ও যুক্তির আলাদা একটি ধরণ আছে। বিএনপির লোকেরা যদি কাউকে খুন করে, কাউকে গণধর্ষণ করে, তা হলে তার সপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে তাদের কোনো জুড়ি নেই। এ-ব্যাপারে আমার সবচেয়ে দক্ষ বলে মনে হয় তাদের ‘কমরেড’ নেতা নজরুল ইসলাম খান ও মৌলোভী মওদুদকে।
২০০১ সালে এইসব নেতা কোথায় ছিলেন? তারা কি দেখেননি কীভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করার হয়েছে? পূর্ণিমার সেই লজ্জাঢাকা মুখ আর হাহাকারভরা বুক কি তাদের মনে একটুও দোলা দিয়েছে? দেয়নি। তা হলে সুবর্ণচরে ধর্ষিত ৪ সন্তানের জননী… জন্য তাদের মায়াকান্না কেন? এটা তাদের মানায়?
আমার এবং নির্মলেন্দু গুণের মতোর দুজন কবি যখন বিএনপির তাণ্ডবের ভয়ে নৈঃশব্দ্যের প্রহরে আতংকিত মুখে একটি স্তব্ধতা-মেশানোর ঘরে পরস্পরের ঘন নিশ্বাস শুনছিলাম, তখন এইসব নেতার কোনো ভূমিকা তো চোখে পড়েনি! এতো তাণ্ডব, এতো ধর্ষণ, এতো ম্যাসাকার দেখে আপনাদের আত্মা কেন একটু নড়েও ওঠেনি? ভেবেছিলেন, হিন্দুদের ওপর অত্যাচার আপনাদের বৈধ অধিকার?
আমি গতকাল যে কাহিনিটি লিখেছিলাম, হয়তো তা আপনাদের চোখে পড়েনি। যে পলাশীতে আমি একটানা উনিশ বছর জীবন কাটিয়েছি, আমার সন্তানরা যে এলাকায় বড় হয়ে উঠেছে, যেখানকার স্কুলে পড়াশোনার করেছে, সেখানে যে আমার মতো লোককেও মাথার নীচু করে চোরের মতো ঘরে ঢুকতে হলো, তার দায় আপনারা এড়াবেন কী করে? ঘরে ঢুকে যে আমি দেখলাম, আমার ছোট দুটি ছেলে ও তাদের মা দক্ষিণের জানালা দিয়ে দেখছে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দাউ দাউ করে জ্বলে যাওয়া এবং আশপাশের বাড়ির ছাদ থেকে শত শত লোকের তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা? আমার বড় ছেলের বন্ধু, কুমুদ, যে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে তাণ্ডবের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলো, উচ্ছৃঙ্খল আক্রমণকারীদের প্রতি গুলি ছোঁড়ার অনুরোধ জানানোতে পুলিশের বন্দুকের বাট দিয়ে তাকে ভয়ংকরভাবে আহত করা এবং ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দেয়াল টপকে আমার বাসায় আহত অবস্থায় আশ্রয় নেয়াসহ তসলিমা নাসরিন ও আহমদ ছফার আমার বাসায় আগমন এবং আমাকে সান্ত¡নার দেয়া যে সারাজীবন মানবতার সাধনা করা আমাকে মুহূর্তে মানুষ থেকে হিন্দু বানিয়ে দিলো, এই কষ্ট আপনার বোঝেন? এর দায় কে নেবে মাননীয় বিএনপি নেতৃবৃন্দ? গয়েশ্বও রায় বা নিতাই রায়চৌধুরীদের মতো কিছু দালালদের রেখে প্রমাণ করতে চান আপনারা হিন্দুদের ব্যথায় সমব্যথী? ক্ষমতায় গেলে আপনারা সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় করবেন, নির্বাচনের আগে এ সব কথা যখন আপনারা বলেছেন, তখন আমার চেখের সামনে ভেসে উঠেছে ৩০০০ হাজার মন্দিরের ধ্বংসপ্রাপ্ত চূড়া আর লজ্জায় মুখ ঢেকে রাখা পূর্ণিমার ও শেফালীদের মুখ। আপনাদের মুখে এসব বুলি মানায়?
লেখক : কবি ও সংযুক্ত সম্পাদক, দৈনিক আমাদেও নতুন সময়
আপনার মতামত লিখুন :