শিরোনাম
◈ দেশের ৯২ শতাংশ মানুষ দ্বিতীয় কোনো ভাষা জানেন না, সময় এসেছে তৃতীয় ভাষার ◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামের জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা

প্রকাশিত : ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮, ০৬:০৪ সকাল
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮, ০৬:০৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সংসদে নারী সংরক্ষিত আসন

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু, স্টকহোম : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় বঙ্গবন্ধু বলেছেন ৭০এর নির্বাচন হয়েছিল যখন বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এখন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। সুতরাং এই স্বাধীন দেশে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করবে। সে মোতাবেক ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩, জাসদ ১, জাতীয় লীগ ১ ও স্বতন্ত্র ৫ আসন লাভ করে।

এই সময় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় নারীদের জন্য ১৫ আসন সংরক্ষিত করা হয়। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল নারীদের রাজনীতিতে উৎসাহিত করা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভের কারণে সংসদে মহিলাদের সংরক্ষিত ১৫ আসন তাদের পক্ষে আসে। ১৯৭৯-৮২ বাংলাদেশে দ্বিতীয় নির্বাচনের সময় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৫ থকে বৃদ্ধি করে ৩০ করা হয়। জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বাজাদল) থেকে দুইজন মহিলা প্রার্থী সরাসরি এই নির্বাচনে প্রতিদ¦ন্দি¦তা করে জয়লাভ করেন। ফলে জাতীয় সংসদে মহিলা আসন সংখ্যা ৩২’এ এসে দাঁড়ায়।

১৯৮৬ সালে দেশের তৃতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে সরাসরি প্রতিদ¦ন্দি¦তা করে, জাতীয় পার্টি ৪টি, আওয়ামী লীগ ১টি মহিলা আসনে জয়লাভ করে। পাঁচ জন মহিলা সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ¦ন্দি¦তা করে জয়লাভ করায় জাতীয় সংসদে মহিলা আসন সংখ্যা ৩৫ হয়। তবে আন্দোলনের কারণে এই জাতীয় সংসদ তাদের পুরো মেয়াদকাল শেষ করতে পারেনি।

১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের চতুর্থ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সারা দেশবেপী এক ব্যাপক আন্দোলনের মুখে পরে সরকার। ফলে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে নব্বইয়ে ক্ষমতা থেকে সরে আসতে বাধ্য করা হয়। এই নির্বাচনে সরাসরি ভোটে চারজন মহিলা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১-১৯৯৫ সালে ছিল বাংলাদেশের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে ৩ ও বিএনপি থেকে ১ একজন নারী সরাসরি ভোটে জয়লাভ করেন। এই চারটি আসন নিয়ে পঞ্চম জাতীয় সংসদে মহিলা আসন সংখ্যা ৩৪ এসে দাঁড়ায়।

পাঁচ বৎসর পর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে তিনজন মহিলা প্রার্থী জয়লাভ করেন। তবে আওয়ামী লীগ সহ বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচন বয়কট করলে একই বৎসর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালেই সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিলে সরাসরি ভোটে আওয়ামী লীগ ৩, বিএনপি ৩ ও জাতীয় পার্টি থেকে ২ জন নারী প্রার্থী জয়লাভ করেন। ফলে সংসদে মহিলা আসন সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮ হয়। এই নির্বাচনের সময়কাল ছিল ১৯৯৬ – ২০০১ পর্যন্ত। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দীর্ঘ ২১ বৎসর পর আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।

২০০১-২০০৬ অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো বিএনপির সাথে জোট বেঁধে জামায়াত নির্বাচন করে। ফলাফলে বিএনপি পূর্বের ৩ আসন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ মহিলা আসন লাভ করে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন ফলাফল বয়কট করা স্বত্ত্বেও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হয়। শুধু তাই নয় স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো সরাসরি জামায়াত থেকে মন্ত্রী করা হয়। সুপরিচিত এরা কেউই বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। উল্টো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। নির্বাচন ফলাফলে ৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি ১৯৩ ও আওয়ামী লীগ ৬২, জামায়াত ১৬, জাতীয় পার্টি ১৪, জাতীয় পার্টি নাজিউর ৪, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ২, স্বতন্ত্র ও অন্যান্যরা ৯টি আসন লাভ করে। এই নির্বাচনে আনুমানিক ১৪০ ব্যক্তি প্রাণ হারায়।

পরবর্তীতে ২০০৬-২০১০ নবম নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি জামায়াত সরকার ও আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হলে সামরিক বাহিনীর সমর্থনে ডক্টর ফখরুদ্দিন আহমেদ সরকার গঠন করেন। একটানা দুই বৎসর ক্ষমতায় থেকে অবশেষে ২০০৮ সালে দেশে নবম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পূর্বে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় নুতন ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়। কারণ অতীতে বিএনপি জামায়াত সরকার অনেক ভুয়া ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করায় সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকার নুতন ভোটার তালিকা তৈরি করতে বাধ্য হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতের ভরাডুবি হলে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০, বিএনপি ৩০, জাতীয় পার্টি ২৭, জামায়াত ২, স্বতন্ত্র ৪ অন্যান্যরা ৭টি আসন লাভ করে। এই নির্বাচনে ১৯ মহিলা প্রার্থী সরাসরি প্রতিদ¦ন্দি¦তা করে জয়লাভ করেন যা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে।

পরবর্তীতে দেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে বিএনপি জামায়াত সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে জ্বালাও পোড়াও ও ধংসাত্বক তৎপরতা করে নির্বাচনকে বানচাল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বিএনপি জামায়াত সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রত্যাখান করে। তারা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সংসদে তার বিরোধী দলীয় পদটি হারান। এজন্য বিএনপি জামায়াত সহ বিরোধী দলগুলোকে দোষ দেওয়া যেতে পারে। কারণ সরাসরি নির্বাচন বয়কট না করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জাতীয় সরকারে এসে তাদের নির্বাচন কাঠামোর অনেক কিছুই পরিবর্তন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু তারা সেদিকে না গিয়ে দেশ ধ্বংসের পথ বেছে নেয়। দেশের জনগণ তাদের এই ধ্বংসাত্বক কার্যকলাপের প্রতি সমর্থন জানায়নি সেদিন। ফলে শুধুমাত্র দলীয় কর্মীদের নিয়ে এপথে নেমে বিএনপি জামায়াত জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে।

এদিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে সংসদে আওয়ামী লীগ সরকার মহিলাদের সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৩০ থেকে বৃদ্ধি করে ৫০ করে। ফলে, জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যের সংখ্যা এখন মোট ৩৫০।

বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ও সরকারে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নারীর ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং স্পিকারের মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বর্তমানে বহাল আছেন তিন জন নারী। বিএনপির নেতৃত্বেও এখন পর্যন্ত আছেন বেগম খালেদা জিয়া। এছাড়া কয়েকজন মহিলাকে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কয়েকজন নারী মন্ত্রী ও সরকারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে মহিলাদের আসার সুযোগ হয়। শেখ হাসিনাকে এই কারণে একজন নারীবাদী নেত্রী আখ্যায়িত করা যায়।

তবুও বলবো বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো পুরুষতন্ত্রের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট থেকে মাত্র ২০ জন ও ঐক্যফ্রন্ট থেকে মাত্র ১৪ জন নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। দেশের নারী ভোটার মোট জন্যসংখ্যার যদি অর্ধেক হয়ে থাকে তাহলে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ নারী প্রার্থীকে আওয়ামী লীগ ও ঐক্যফ্রন্ট থেকে নমিনেশন দেওয়াটা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। আগামীতে এব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে হবে।

দুইবৎসর পূর্বে সুইডিশ জাতীয় সংসদের দুই সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধিদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একান্ত সাক্ষাৎকালে সফরকারীদের রাখা বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের সরকার নারীদের বিভিন্ন পেশায় সামনে নিয়ে আসার লক্ষ্যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে সামরিক বাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী সহ সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে মহিলাদের চাকুরীর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। অতীতে কোনো সরকারই নারীর ক্ষমতায়ন এধরনের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। দেশে নারীদের যোগ্যতাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকারটুকু পায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন আমাদের সরকার ভবিষ্যতে এবিষয়ে আরো কাজ করতে আগ্রহী।

এখন প্রশ্ন হলো দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানে সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি? বিষয়টি নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক মহল নুতন করে ভেবে দেখতে পারে। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির অঙ্গনে মহিলাদের সক্রিয়তা পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি। শুরুতে বঙ্গবন্ধু নারীদের রাজনীতিতে এগিয়ে আসার লক্ষ্যে যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন আজকের অবস্থানে তার গুরুত্ব কতটুকু? আসছে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অনেক নারী এককভাবে প্রতিদ¦ন্দি¦তা করছেন এবং এদের অনেকের জয়লাভ করার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের নারী ভোটার মোট জন্যসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। সুতরাং সংসদে নারী আসন সংরক্ষণ বিষয়টি নিয়ে ভবিষ্যতে নুতন করে আলোচনা হতে পারে। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিবেচনা করলে নারী পুরুষ সকলেরই সমান অধিকার থাকা উচিত।

আগামী নির্বাচনগুলোতে নারীদের সরাসরি কমপক্ষে ৪০ শতাংশ প্রার্থীতা সৃষ্টি করলে তখন আর সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন হবে না। নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করে বরং তাদের যোগ্যতাকে এখন আরো ছোট করা হচ্ছে। নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর ও অধিকার নিশ্চিত করতে গিয়ে এই পথে বাংলাদেশ আর কতদিন চলবে? আশাকরি বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা আসছে সংসদে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে একটি সমাধানে আসবেন। লেখক : সুইডিশ লেফট পার্টি (ভেনস্টার পার্টি) সেন্ট্রাল কমিটির মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ও সুইডেনে মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয়। সম্পাদনা : নুসরাত শরমীন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়