বিচিত্রা সেন : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। মা ঠাকুরমা দিদিমার মুখে শুনেছি ১৯৭১ সালের এইদিনে যখন বাঙালিরা বিজয়ের আনন্দে খুশিতে আত্মহারা তখন আমাদের পরিবারে, মামাদের পরিবারে চলছে বুক চাপড়ানো বিলাপ। কারণ মাত্র চারদিন আগে ১১ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় তুলে নিয়ে গেছে আমার বাবা, কাকা এবং দুই মামাকে। বাবাকে ভালো করে চেনার আগেই আমার বাবা আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছেন। তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি তখনো পর্যন্ত এবং এখনো পর্যন্ত। সব পুরুষ সদস্যকে হারিয়ে আমাদের দুই পরিবারে চলছে তখন শোকের মাতম। কিন্তু তখন বিজয়ের আনন্দে স্বজন হারানো লোকদের পাশে দাঁড়ানোর সময় কারো নেই। সবাই জানে, সবাই চেনে, কিন্তু মুষ্টিমেয় চার/পাঁচজন ছাড়া কেউ একবার উঁকি দিয়েও দেখেনি আমাদের দুই পরিবারকে,পাছে কোনো দায়িত্ব নিতে হয়।
খুব ছোটবেলা থেকে যখন বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে বক্তাদের কথার ফুলঝুড়ি শুনতাম, শহীদদের জন্য গভীর মমতার কথা শুনতাম তখন ভেতর থেকেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতো কথা এবং কাজের এতোটা অমিল দেখে। তারপর এক সময় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম কথাগুলো কানে নিয়ে মনে না নিতে। এখনো সেই অভ্যাসটা বজায় রেখেছি। আজকেও অনেক কথা শুনলাম,শহীদদের জন্য অনেক বেদনা শুনলাম আর মনে মনে হাসলাম। হ্যাঁ, এখন আমার হাসিই আসে, কান্না আর আসে না, ছোটবেলায় আসতো। তিরিশ লাখ শহীদের কথা সবারই জানা,শুধু অজানা তিরিশ লাখ শহীদের পরিবারের লোকজনের বুকভাঙা কান্নার কথা, দীর্ঘশ্বাসের কথা, চেনা মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানোর কথা। গতমাসে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের এক অধ্যাপক বললেন, ‘আপনাদেরকে আমরা করুণা জানাতে পারি, সহানুভূতি জানাতে পারি, কিন্তু আপনাদেরকে আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বলতে পারবো না’।
হায়রে মুক্তিযোদ্ধা, গুষ্ঠিশুদ্ধ মরে গিয়েও রেহাই নেই!তাকে আবার প্রমাণ করতে হবে যে তিনি মুক্তিযুদ্ধে কাজ করতে গিয়েই মরেছেন! আরেক অধ্যাপক বললেন, ‘শহীদ পরিবার হিসেবে অধিকারের কথা বলা নাকি ভিক্ষা চাওয়া’! ধিক্কার দিই অধ্যাপক নামক এমন জ্ঞানপাপীদের। এতো সব কথা বলার একটাই কারণ, বিজয়ের উৎসব পালনের সময় আমরা যেন ভুলে না যাই এ বিজয়ের নেপথ্যে আছে আমার মতো লাখ লাখ মানুষের স্বজন ও সর্বস্ব হারানোর বুকভাঙা কান্না। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :