বাবলু ভট্টাচার্য : ১৯৪৭ সালের দেশভাগ আরও বহু কিছুর মতো বাঙালির সাহিত্যকেও দ্বিখ- করেছিলো। বাঙালির ইতিহাস নতুন পথে বাঁক নেওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কথাসাহিত্যের ভার যারা হাতে তুলে নিয়েছিলেন, দেবেশ রায় ছিলেন সেই নবীনদের দলে। নবীনদের মধ্যে তিনি ছিলেন বটে, তবে ঠিক দলের ছিলেন নাÑ না ভাবনায়, না লেখায়, না সাহিত্যে তার অনুসন্ধানে।
ক্রমশ পাকা হয়ে ওঠা কথাসাহিত্যের রাজপথ ছেড়ে আস্তে আস্তে তিনি সরে আসেন নিজের গড়ে তোলা এক আলপথে এবং বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন। তার শৈশবের কয়েকটি বছর কাটে উত্তাল যমুনার পাড়ে। দেশভাগের কিছু আগে, ১৯৪৩ সালে, তিনি তার পরিবারের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে জলপাইগুড়ি চলে যান।
‘যযাতি’ দিয়ে দেবেশ রায়ের উপন্যাসের সূচনা। কিন্তু ভারতের রাজনীতি যখন নকশালবাড়ি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থায় টালমাটাল, বাংলা সাহিত্যে তার নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চারের সূচনা ঘটে সেই ১৯৭০ দশকে। ‘মানুষ খুন করে কেন’, ‘মফস্বলী বৃত্তান্ত’, ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্তÑ একের পর এক উপন্যাসের অফুরন্ত প্রবাহ তার শৈশবের নদী যমুনার মতো পাঠকের অভিজ্ঞতা ভেঙেচুরে একাকার করে দেয়। এ অভিজ্ঞতা তুঙ্গে পৌঁছয় তার ‘তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত’-এ। রূপায়িত ইতিহাস আর মানুষের অচরিতার্থ স্বপ্নের চিরন্তন দ্বন্দ্বের এক মনুষ্যপ্রতিমা তার এ উপন্যাসের চরিত্র ‘বাঘারু’। উপন্যাসটির জন্য ১৯৯০ সালে তিনি অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন।
বাংলা ভাষা ও কথাসাহিত্য নিয়ে বহু মৌলিক প্রস্তাবও দেবেশ রায় তুলেছেন তার উপন্যাস নিয়ে। উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে, উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য বইগুলোতে। বাংলা সাহিত্যে উপনিবেশের প্রভাব ও বাংলা ভাষার নিজস্ব প্রতিভা তার অনুসন্ধানের বিষয়।
গত দেড় দশক ধরে দেবেশ রায়ের অন্যতম কৌতূহল বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জনজীবন। তার বীক্ষণের মূল্য এই যে বিরাজমান গৎবাঁধা দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যের পিঠ চাপড়াতে বসে যান না। পূর্ববঙ্গের পথরেখার তাৎপর্য তিনি বুঝতে চান এখানকার মানুষের সংগ্রামের নিজস্ব ইতিহাস থেকে। বাংলাদেশের নির্মীয়মাণ নাগরিকতা ও বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপের ঐশ্বর্যÑ এই দুয়ের মধ্যে দেখতে পান এ দেশের সাহিত্যের এক উর্বর জমি। দেবেশ রায় ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :