শিরোনাম
◈ চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন, নিয়ন্ত্রণে ১২ ইউনিট ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী

প্রকাশিত : ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৮, ০৫:০৭ সকাল
আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৮, ০৫:০৭ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘যে তুমি হরণ করো’-র কবিকে স্মরণ

ড. সেলিম জাহান

না, তার সঙ্গে আমার সখ্যতা ছিলো না, হওয়ার কথাও নয়। বয়সের তেমন তারতম্য একটা অবশ্য ছিলো না। বছর পাঁচেকের বড় তিনি। দুজনেরই বেড়ে ওঠা বরিশালে। থাকতাম দুজনেই সলিমুল্লাহ হলে। বেশ কিছু বন্ধু ছিলো তার, যাদের সাথে সখ্য ছিলো আমারও। এতোসব জিনিস অভিন্ন হলে সখ্যতার একটা সম্ভাবনা থেকে যায় বইকি। কিন্তু তা হয়নি আমাদের দুজনের মধ্যে, কারণ দূরত্ব ছিলো মূল জায়গায়Ñ তার আর আমার জগৎ আলাদা। তবু সখ্যতা না থাকলেও একটা হৃদ্যতা ছিলো কবি আবুল হাসান আর আমার মধ্যে।

২৬ নভেম্বের ছিলো হাসান ভাইয়ের প্রয়াণ দিবস। ১৯৭৫ এর ২৬ নভেম্বর ছেড়ে গিয়েছিলেন তিনি আমাদের। বেঁচে থাকলে সত্তর পেরিয়ে যেতেন। ভাবা যায়? আমার মনে তার তরুণ অবয়বটিই স্থির হয়ে আছে। আমরা সময়ের রেখা ধরে বয়সী হয়েছি, কিন্তু হাসান ভাই সেই ২৯ বছরের যুবকই রয়ে গেলেন।

কতো ছোটখাটো কথা মনে হয়। স্নান করার জন্যে দীর্ঘ বারান্দা ধরে হেঁটে স্নানাগারে যেতে হতো। প্রায়শই হাসান ভাই স্নান সেরে তার কোঁকড়া চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে আমার ঘরে আসতেন। হাত বাড়িয়ে বলতেন ‘দিন’। বিনা বাক্যব্যয়ে তুলে দিতাম তার হাতে। না, তেমন কোনো মহার্ঘ বস্তু নয়Ñ সেরেফ কটি নিউজ প্রিন্টের পাতা। ধোবীখানা থেকে আমাদের জামা-প্যান্ট ধুয়ে এসে তার ভাঁজে ভাঁজে দস্তরখানের মতো নিউজপ্রিন্টের পরত পুরে দেয়া হতো। সেগুলোতে ডট কলম দিয়ে কবিতা লিখতে বেশ মজা পেতেন হাসান ভাই। হয়তো তার অনেক নামি-দামি কবিতা আমার কাগজের নামাবলী পরেই জন্মলাভ করেছেÑ কে জানে?

তার সঙ্গে বেশির ভাগ সময়েই দেখা হতো আমাদের তীর্থস্থানেÑ শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে। আমাদের হৃদ্যতার ঘণীভবনও সেখানেই। একদিন খাঁ খাঁ গরমের মধ্যে সেথায় গেছি। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। এক গেলাস জল চাইলাম রমজান ভাইয়ের কাছে। দেখি এক টেবিলে হাসান ভাই শরীফ মিয়ার সেই বিখ্যাত এক টাকা দামের পুরো প্লেট বিরিয়ানী খাচ্ছেন। কোনার এক টেবিলে শাহনূর খান, সাজ্জাদ কাদির, রফিক নওশাদ এবং আরো কজন মিলে জোর আড্ডা দিচ্ছে। আমাকে দেখে হাসান ভাই বললেন, ‘কি, খাবেন না?’ ঠোঁট উল্টে বললাম , ‘পয়সা নেই’। আমাদের কথাবার্তা শরীফ মিয়ার কানে গেছে।

‘আমনে খামাখাই খালি প্যাঁচাল পারেন। পয়সার কতা ক্যাডা জিগাইছে আমনেরে?’ ধমকে উঠলেন শরীফ ভাই। ‘বিতর্ক ( শরীফ মিয়া বিতর্ক বলতে পারতেন না) কইরা কইরা প্যাঁচাল পারেনের অইভ্যাস হইছে আমনের’Ñ ভারী বিরক্ত তিনি আমার ওপর।’এই রমজাইন্না, একডা ফুল পেলেট বিরিয়ানী লামাইয়া দে ছলিম সা’বের ছামনে’Ñ আমার নামটাও শরীফ ভাই ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতেন না। তাকিয়ে দেখি, হাতে জলের গেলাশ তুলতে তুলতে মুচকি মুচকি হাসছেন তিনি। ভাবখানাÑ ‘বেশ হয়েছে’। এতো বছর বাদেও গোঁফের ফাঁকে হাসান ভাইয়ের সে দুষ্ট হাসিটি এখনো দেখতে পাই।

সেই সঙ্গে এখনো শুনতে পাই ওই কথা কটিÑ ভালো লাগছে একটু এখন? বহুদূর থেকে কথা কটি যেন ভেসে এসেছিলো। আস্তে করে চোখ মেলতে যেন কুয়াশার ভেতর থেকে আবছা একটা মুখ দেখতে পেয়েছিলাম। ওই এক মুহূর্তে তিনটে জিনিস ঠাহর করতে পেরেছিলামÑ জ্বরে গা পুড়ছে যাচ্ছে, একটা ঘোরের মধ্যে আছি এবং ওই মুখটি হাসান ভাইয়ের। কতোকাল আগের কথাÑ প্রায় ৪৫ বছর, তবু এখনও মনে আছে স্বচ্ছ।

সত্তর দশকের প্রথম দিকেÑ কোনো এক ঈদে মা-বাবার কাছে যাচ্ছি বরিশালে। সকাল থেকেই গায়ে গায়ে জ্বর ছিলো কিন্তু মনে হলো কিছু হবে না, সেরে যাবে। বিকেলে সদরঘাটে গিয়ে যা দেখলাম তাতে মনে হলো, ওই অবস্থায় সুস্থ লোকেরও জ্বর চলে আসবে। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ, ঠেলাঠেলি, হাতাহাতিÑ লঞ্চ, স্টিমারে ওঠার জন্যে মরণপণ লড়াই। তার মধ্যেই দেখি হাসান ভাই, আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। বহুদিন পরে বরিশাল যাচ্ছেন, ছোট বোনটিকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, লাজুক চোখে জানালেন তিনি। হাসান ভাইয়ের লাজুক চোখ ও রাগী মুখ দুটোর সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিলো আমার। ততোক্ষণে আমার জ্বর চড় চড় করে বেড়ে যাচ্ছে।

এবং এক পর্যায়ে আমি সংজ্ঞা হারালাম।

তারপরই প্রথম যে কথাটি শুনতে পেলাম, তা হচ্ছে ‘ভালো লাগছে একটু এখন’? পাতলা-দুবলা হৃদরোগী হাসান ভাই কেমন করে সেই উন্মত্ত জনতার ব্যূহ পেরিয়ে আমাকে স্টিমারে তুলেছিলেন, কেমন করে প্রথম শ্রেণির খাবার ঘরের একটি বেঞ্চিতে শুইয়ে দিয়েছিলে, কেমন করে সারারাত জেগে থেকে আমার মাথায় জলপট্টি দিয়েছিলেন তা এখনও আমার কাছে এক রহস্য। শুধু চেতনার কোন কোণা থেকে নিরন্তর শুনতে পাই ‘ভালো লাগছে একটু এখন’? ‘যে তুমি হরণ করো’ র কবি আবুল হাসান সে রাতে আমার হৃদয় জয় করেছিলেন, কোনো কিছুই তাকে হরণ করতে হয়নি।

তার সঙ্গে শেষ দেখার কথাও মনে আছে আমার। অসুস্থ তিনি তখন। উচ্চশিক্ষার্থে আমার তখন কানাডা আসা স্থির হয়েছে। কথা-বার্তার কোনো এক ফাঁতে হাসান ভাই খুব উদাস চোখে বাইকে তাকালেন জানালার শার্সি গলিয়ে। তারপর খুব নরম গলায় বললেন, ‘এখানে খুব বরফ পড়ে, না?’ আমি মৃদুকণ্ঠে বললাম, ‘হ্যাঁ’। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন তিনি। তারপর প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘আমি কোনোদিন তুষারপাত দেখিনি’।

আর কদিন পরেই তুষার পড়া শুরু হবে এখানে। বরফে বরফে ছেয়ে যাবে চারিদিক। শ্বেতশুভ্র সে বরফ দেখে কোনো একদিন খুব ভোরে আমি সেই বরফের মধ্যে হাঁটতে বেরুবো। পায়ের বুটের নিচে বরফ ভাঙ্গার মচমচ শব্দ হবে। কনকনে ঠান্ডা এড়াতে গরম কোটের কলারটা আমি তুলে দেবো, গলার মাফলারটা আরো ভালো করে পেঁচিয়ে নেবো, মাথার টুপিটা নামিয়ে নেবো বেশ কিছুটা। তখনই হয়তো আমার ঘাড়ের কাছে ফিসফিসানি স্বরে শুনতে পাবো, ‘বাহ্, ভারী সুন্দর তো তুষারাবৃত পৃথিবী’। হয়তো ...।

লেখক : অর্থনীতিবিদ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়