অভাজন : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে ডিগবাজির খেলা যা হলো, তা অতীতের সব রেকর্ডকে মনে হয় ভঙ্গ করেছে। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, স্বাভাবিক সময়ে অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে রাজনীতিতে দল-বদল এবং এমনকি উল্টো মত-পথের দলে যোগদান অস্বাভাবিক কিছু নয়। একে ডিগবাজি বলা যাবে না। কিন্তু নিছক মনোনয়ন পাওয়া, জিতে জনপ্রতিনিধি তথা এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য উল্টোমুখি হওয়াটা সার্কাসের জোকারের ডিগবাজির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বলাই বাহুল্য, মানুষ দলবদল পছন্দ করে না। তবে সার্কাসের সময় যেমন মানুষ ডিগবাজিতে আনন্দ পায়, তেমনি নির্বাচনে মার্কা জেতাটা প্রধান হওয়ার কারণে মানুষ তখন সাধারণভাবে তাতেই মেতে ওঠে।
অতীতের কথা বাদ দিয়ে যদি বাংলাদেশের ৪৭ বছরের রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করা যায় তবে দেখা যাবে, নির্বাচনের সময় বাদে আরো একটি সময়ে রাজনীতিতে ডিগবাজির খেলা জমেছে। সময়টা হচ্ছে হত্যা-ক্যুয়ের পর থেকে সেনাশাসকদের দল করার সময়ে। এই বিবেচনায় দেশের প্রথম ডিগবাজির খলনায়ক হচ্ছে খুনি মোশতাক। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগেও যে ব্যক্তিটি ছিলো গায়ে গতরে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর অনুসারী এবং মন্ত্রী, তিনি ডিগবাজি খেয়ে রক্তের ওপর দিয়েই চলে গেলেন পরাজিত পকিস্তানপন্থীর দলে। অস্ত্রের মুখে প্রাণের ভয়ে যেসব আওয়ামী লীগ নেতারা জাতীয় চার নেতার মতো প্রতিবাদী হয়ে জীবন দিতে পারেননি এবং খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন, তারা ভীতু বা কাপুরুষ হতে পারেন, তাদের তেমন সাচ্চা আওয়ামী লীগার নয়ও বলা যেতে পারে; কিন্তু সেসব পক্ষবদল ডিগবাজি বলা যাবে না। ডিগবাজি বলা যাবে এক সময়ের ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা খুনি মোশতাকের সহযোগি প্রয়াত ওবায়েদুর রহমান ও বর্তমান নির্বাচনে বিএনপির শাহ মোয়াজ্জেমদের।
স্বাধীন বাংলাদেশে ওই যে শুরু হয়েছে রাজনীতির জোকারদের ডিগবাজি, তা চলতে চলতে বর্তমানে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যেন সর্বোচ্চ রূপে পৌঁছেছে। তবে রাজনীতির লীলাখেলার নাটক চলছে এবং চলবেই, তাই সর্বোচ্চ পর্যায় বলাটা ঠিক হচ্ছে কি না জানি না! আরো কতো রঙ্গ যে দেখতে হবে দেশবাসীকে কে জানে! মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু যাকে পররাষ্ট্র বানিয়েছিলেন, যিনি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী, নৌকা নিয়ে যিনি বার বার নির্বাচন করেছেন; ‘রুগ্ন রাজনীতি’ দূর করার সেই দৃঢ়প্রতীজ্ঞ কাণ্ডারি এখন প্রত্যক্ষভভাবে বিএনপি এবং পরোক্ষভাবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধী দল জামাতের সাথে। হায়রে ড. কামালের ‘সুস্থ রাজনীতি’! জাতিসত্তাবিরোধী রাজনীতি কি কখনও ‘সুস্থ’ রাজনীতি’ কিংবা ‘গণতন্ত্র রক্ষার রাজনীতি’ হতে পারে! শুনলে মরা মানুষও হাসবে।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, অধ্যাপক আবু সায়ীদ, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর প্রমুখরাও এবারে ডিগবাজির খেলা ভালোই দেখিয়েছেন। তবে আসম আব্দুর রব ও মাহমদুর রহমান মান্না ডিগবাজির খেলায় তাদেরও ছাড়িয়ে গেছেন। রব সাহেব আওয়ামী লীগ থেকে ডিগবাজি দিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নায়ক হতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাসদ, তারপর ডিগবাজি দিয়ে হয়েছিলেন সেনাশাসক এরশাদের আমলে বিরোধী দলীয়নেতা তথা ‘গৃহপালিত পশু’, তারপর আওয়ামী লীগের আমলে মন্ত্রী হয়েছিলেন। এই নিয়ে এই নেতার ডিগবাজির সংখ্যা হলো চার। এক্ষেত্রে মান্না সাহেব অবশ্য একটু পিছিয়ে আছেন। তিনি দিলেন তিনবার ডিগবাজি। বিপ্লব-নৌকা-ধানের শীষ! মোস্তফা মহসীন মন্টুও দিতে পারেন তাদের সাথে পাল্লা। মাঝে তিনি যোগ দিয়েছিলেন সরাসরি বিএনপিতে। ১৯৬৯ সালে এক হত্যা মামলার রায়ে প্রাণদণ্ড হয়েছিল তার। বঙ্গবন্ধু টেলিগ্রাম করেছিলেন ইয়াহিয়ার কাছে। প্রাণ তার বেঁচে গিয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবন থেকে উৎখাত করার মার্কা হচ্ছে ধানের শীষ। মন্টু সাহেব আসলে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদান নিজের বৈশিষ্ট্য মতো ভালোই দিলেন।
উপরে যতোটুকু বলা হলো, তাতে কেবল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ থেকে বিপক্ষে ডিগবাজির খেলাটারই বর্ণনা দেওয়া হলো। ঠিক বিপরীত ডিগবজিও যে আছে! ধানের শীষ থেকে নৌকায় ডিগবাজি! মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ থেকে পক্ষে ডিগবাজি! তাও আবার সেই ডিগবাজি দিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি! রঙ্গখেলার প্রথম অংশে ছিলো মৃত্যু বাঁচাতে রেল লাইন দিয়ে দৌড়। এবার দিলেন ডিগবাজি। অবশ্য পিতার পথে তিনি কিংবা মাহী দাদুর পথে গেছে এটাই সান্তনা। ডা. বদরুদ্দোজার পিতা সাবেক এমপি আওয়ামী লীগের কফিলউদ্দিন চৌধুরী যদি পরপার থেকে পুত্র ও নাতির ডিগবাজির খেলা দেখেন, তবে নিঃসন্দেহে পাবেন শান্তি। বৃদ্ধ বয়সে ডাক্তার সাহেব সঠিকভাবেই হয়েছেন বাপকা বেটা।
তবে ডিগবাজির এই রঙ্গখেলা থেকে একটা রাজনৈতিক সত্য বের হয়ে এসেছে। আর তা হলো যদি কেউ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ আর রাজনীতি করা তথা এমপি-মন্ত্রী হওয়ার বাসনা থাকে উগ্র, তবে তার স্থান হবে নিঃসন্দেহে বিএনপি-জামায়াত জোটের ঘরে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আছে দুই পক্ষ আওয়ামী লীগ আর এন্টি আওয়ামী লীগ।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক
আপনার মতামত লিখুন :