জাকির তালুকদার : প্রতিটি মানুষই তার কাজের স্বীকৃতি চায়। সেটি পরিবারের কাছ থেকে হোক আর কর্মস্থলের সহযোগীদের কাছ থেকেই হোক। আর বন্ধু মহলের কাছে তো অবশ্যই। অনেক মধ্যবিত্ত সংসারে অশান্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায় পরস্পরের অবদানের এই স্বীকৃতি না দেওয়া। অনেক অফিসে বা কর্মস্থলে কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায় এই যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান না করার কারণে। সেই স্বীকৃতি নানাভাবে হতে পারে। মৌখিক সম্মান, পদোন্নতি, উপহার প্রদান, সম্মাননা প্রদান।
জাতির জন্য যারা বড় বড় কাজ করে থাকেন, তারাও স্বীকৃতি লাভ করবেন এটাই কাম্য। এই স্বীকৃতি এবং সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে জাতি আসলে যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তার জীবন ও কর্মের। কারো কারো জন্য আসে আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং স্বীকৃতিও। সেইসব প্রাপ্তি জাতিকেও গর্বিত করে তোলে।
কিন্তু পুরস্কার বা সম্মাননা মাত্রই সবসময় গ্রহণযোগ্য নয়। পুরস্কার কারা দিচ্ছে, কী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দিচ্ছে, আর কারা একই সঙ্গে পুরস্কার পাচ্ছে, পুরস্কারপ্রাপ্তির তালিকায় আর কার কার নাম ছিলোÑ এই সবগুলো বিষয়ই বিবেচনা করতে হবে পুরস্কার গ্রহণের আগে। এই নিবন্ধকার নিজে লেখক, আর বাংলাদেশে কবি শেণির প্রার্থীর সংখ্যা অগণন হওয়ায় সাহিত্যের পুরস্কার নিয়েই বেশি মাতামাতি হয়। এই সুযোগটা গ্রহণ করে অনেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ জাতে ওঠার জন্য পুরস্কার কিনেও নেন, এমনটিও দেখা যায়। ফলাফল নিজেকেই আরো বেশি হাস্যকর করে তোলা।
তাই পুরস্কার গ্রহণের ক্ষেত্রে বাছ-বিচারের কোনো বিকল্প নেই। আর জাতির মহত্তম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই সাবধানতা অনেক বেশি প্রযোজ্য হওয়া উচিত। বিশেষ করে মরণোত্তর ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যেহেতু তিনি নিজে এই ধরনের ক্ষেত্রে কোনো মতামত ব্যক্ত করতে পারছেন না। তার হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন পরিবার এবং অনুসারীগণ। তাদের খুবই সতর্ক হওয়া দরকার।
বঙ্গবন্ধুকে তার দল ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ বলে অভিহিত করে। কোত্থেকে এলো এই অভিধা? বাছাইটা করেছে কে? করেছে বিবিসি। এবং প্রক্রিয়া ছিলো শ্রোতা জরিপ। বঙ্গবন্ধু যে তার অবদানের জন্য হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির সংক্ষিপ্ততম তালিকাতেও জায়গা পাবেন, সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আবার আগামী হাজার বছরেও যে তার স্থান সেই ওপরের তালিকাতেই থাকবে, সে ব্যাপারেও কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিন্তু বিবিসি যে প্রক্রিয়ায় এই নির্বাচনটি করেছে, যতোজন মানুষের মধ্যে এই জরিপটি করেছে, সেই প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ। বিবিসির এই জরিপ মেনে নিলে বাঙালি জাতির কলঙ্ক গোলাম আজমকেও আমাদের মেনে নিতে হবে ২৪ বা ২৫ তম শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে।
তাই বঙ্গবন্ধুকে যদি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির অভিধাটি দিতে হয়, তা দেওয়া উচিত বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতার সপক্ষের বাঙালিদের সমাবেশের মাধ্যমে। এবং সেখানে যে তালিকাটি থাকবে, তাতে কোনোমতেই ঠাঁই হবে না বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের বিরুদ্ধাচারী কারো নামই। তাই বিবিসির জরিপের প্রতিধ্বনি নয়, আমরা চাই বিশ্ববাঙালির হৃদয়ের স্বীকৃতির সনদ।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :