শিরোনাম
◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে ◈ সেনা গোয়েন্দাসংস্থার বিরুদ্ধে ৬ পাক বিচারপতির ভয় দেখানোর অভিযোগ ◈ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা সাদা পতাকা উড়াচ্ছিল, তাদের বূলডোজার দিয়ে মাটি চাপা দিল ইসরায়েলী সেনারা ◈ ইসরায়েলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দ্রুত আরোপ করুন: জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ ◈ যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত ◈ বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ ও মুক্ত গণতন্ত্র বাস্তবায়নে কাজ করে যাবে যুক্তরাষ্ট্র: ম্যাথিউ মিলার ◈ ঈদের পর কমপক্ষে ২৩ ডিসি’র রদবদল হতে পারে

প্রকাশিত : ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ০৩:৫২ রাত
আপডেট : ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ০৩:৫২ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

শহীদ মিলনের জাসদ : প্রতিরোধে প্রতিশোধ?

মাসুদ রানা, ফেসবুক থেকে: তিন দশক আগে বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ আট বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আপোসহীন শক্তিসমূহের মধ্যে একটি ছিলো জাসদ। আর, সে-আন্দোলনে এ-দলটির ট্রেডমার্ক স্লোগান ছিলো : ‘প্রতিরোধে প্রতিশোধ, জাসদ! জাসদ’!

যতোটুকু মনে পড়ে, আন্দোলনের এক পর্যায়ে দুদিনের নিরবচ্ছিন্ন হরতালের প্রথম দিবসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগের কেদ্রীয় কমিটির সদস্য শাহজাহান সিরাজ স্বৈরশাসকের ঘাতক বুলেটে প্রাণ হারালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কমরেডগণ এ- স্লোগান শুরু করেন। এ স্লোগানটির উপলব্ধি ও প্রতিশ্রুতি সম্ভবত : আরও তীব্রতা লাভ করে ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর এরশাদ জান্তার হাতে সংগ্রামী চিকিৎসকদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও জাসদ-কর্মী ডাক্তার মিলনের মৃত্যুর পর। ডা. মিলনের মৃত্যু গণ-আন্দোলনকে বেগবান করে। এ-আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানে রূপ লাভ কওে স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ ও তার দল জাতীয় পার্টির পতন ঘটায়। ফলে, শহীদ ডা. মিলন অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠেন।প্রতি বছরের মতো এ বছরের ২৭ নভেম্বরে শহীদ ডা. মিলনকে স্মরণ করেছে তার পেশাজীবী সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসৌসিয়েশন বিএমএ। সেখানে ভাষণ দিতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন তার প্রাণপ্রিয় দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, যিনি ইতিহাসের নির্মম পরিহাসে আজ ডা. মিলনের হত্যাকারী পতিত স্বৈরশাসক এরশাদের রাজনৈতিক মিত্র এবং ক্ষমতাসীন জোট সরকারের তথ্য ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রী।সঙ্গত কারণেই, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর চলা ও বলা সংবাদ-মাধ্যমের প্রতিবেদনের বিষয়। আর, সেই সুবাদে একই দিবসে দৃশ্যত সরকার-সমর্থক অনলাইন পত্রিকা বিডিনিউজ২৪.কম এক প্রতিবেদনে লিখেছে : ‘নিজের দলের নেতা ডা. শামসুল আলম খান মিলন হত্যাকা-ের জন্য যাকে দায়ী করা হয়, সেই এইচ এম এরশাদের সঙ্গে জোট গড়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছে, সামরিক একনায়কের গড়া দলটি এখন গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরেছে’।এই সেই হাসানুল হক ইনু – মার্ক্সবাদী বিপ্লবী – যিনি এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের অভিযোগ এনে। আর, জেনারেল এরশাদ বলেছিলেন তিনি নাকি ইনুর মতো এতো অকৃতজ্ঞ মানুষ দেখেননি।‘অকৃতজ্ঞ’ অর্থ কী তা আমরা জানি, কিন্তু মার্ক্সবাদী বিপ্লবী হাসানুল হক যে লুটেরা পুঁজিবাদী শ্রেণির প্রতিভূ জেনারেল এরশাদের কাছে অকৃতজ্ঞ প্রতিভাত হলেন, তার অর্থ আমরা জানি না। এর দ্বারা কী বুঝায়, তার সম্ভাব্য দুইমাত্র জ্ঞাতা হচ্ছেন জনসমুখে অকথিত ও অজ্ঞাত কিন্তু ব্যাপক সন্দেহিত ‘উপকারের’ দাতা ও গ্রহীতা। তবে, আজ ২৩ বছর পর হাসানুল হক ইনু যে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের উপকার করেছেন, তা বিলক্ষণ স্পষ্ট।জেনারেল এরশাদ একবার বলেছিলনে তাকে কেউ ‘স্বৈরাচার’ (শব্দটি হবে স্বৈরাচারী) বললে তিনি দুঃখ পান। তাই, হয়তো জেনারেল এরশাদের সে-কষ্ট লাঘবার্থে হাসানুল হক ইনু এবার তাকে ‘স্বৈরাচারী’ না বলে ‘একনায়ক’ বলেছেন। হাসানুল হক ইনু আরও বলেছেন যে, জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি এখন গণতান্ত্রিক ধারায় ‘ফিরেছে’ (!) – যেন একসময় গণতান্ত্রিক ছিলো কিন্তু মাঝখানে পথভোলা হয়ে গিয়েছিলো ‘মেইড ইন ক্যান্টনমেন্ট’ এই দলটি! একই স্থানে একই কায়দায় জন্মানো দল বিএনপির ব্যাপারে হাসানুল হক ইনুর অতি অরুচি। তিনি এর নেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ছাড়া-করার অঙ্গীকার করে বিখ্যাত ‘মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা’ আবিষ্কার করে সম্ভবত : নোবেল প্রাইজের চেয়েও অনেক-অনেক বেশি অর্থমূল্যের মন্ত্রীত্ব পুরষ্কার লাভ করেছিলেন। হায়, জ্ঞানপাপ আর কাকে বলে! এই সেই হাসানুল হক ইনু, যিনি ১৯৮০ সালের আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যের ফলে জাসদ ভাগ হয়ে বাসদ হলে, তার ডিএনজি (ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট) তত্ত্বের উপস্থাপনায় পার্লামেণ্টের ভেতরে গিয়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের উন্মোচন ও বাইরে শ্রমজীবী ও পেশাজীবীর আন্দোলন করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটনের কথা বলতেন! বুয়েটের বৈঠকগুলোতে তিনি উপমা দিয়ে বলতেন, বাঁশের ভেতরে গুঁজ দিয়ে বাইরে থেকে পায়ের চাপ দিলে যেমন বাঁশ ফটাফট ফেটে যায়, তেমনি রাষ্ট্রবিপ্লবের জন্যে পার্লামেণ্টের অংশগ্রহণ হচ্ছে গুঁজ দেওয়া আর বাইরের আন্দোলন হচ্ছে পা দিয়ে চাপ দেওয়া। হায় বিপ্লবী নেতা! হায় তত্ত্ব প্রণেতা! আজ কোথায় তার সেই গুঁজ দেওয়া, আর কোথায় সেই বাঁশ ফাঁটানো? আজ যে তিনি নিজেই গুঁজ হয়ে ফাটা বাঁশের চিপায় আটকে আছেন! তার কাক্সিক্ষত বিপ�ব সুদূর পরাহত! তবে, হ্যাঁ তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। শাসকশ্রেণির অংশে পরিণত হয়েছেন। আমি হাসানুল হক ইনুর চরিত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন নই। আমি বিক্ষুব্ধ আমাদের সংগ্রামের সাথী ও প্রয়াত মিত্র ডা. মিলনের হত্যাকা-ের দিবসে, তাকে স্মরণ করতে এসে তারই হত্যাকারীর উদ্দেশ্যে তারই শ্রদ্ধেয় নেতা হাসানুল হক ইনুর স্তুতিবাক্যে। স্পষ্টত এটি শহীদ ডা. মিলনের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ অবমাননা! আমি অতি নগণ্য ব্যক্তি, কিন্তু স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের সূচনাকারী প্রতিষ্ঠান ডাকসুর তৎকালীন নির্বাচিত কার্যকরী সদস্য হিসেবে, বাংলাদেশ এরশাদ-কবলিত হওয়ার প্রথম দিন ২৪ মার্চ রাত থেকে সংগ্রামে নিযুক্ত কর্মী হিসেবে, এবং সর্বোপরি একই দল না করা সত্ত্বেও অতি বন্ধু-বৎসল মিলনের বন্ধু হিসেবে, আমাদের প্রাক্তন নেতা ও পথভ্রষ্ট মার্ক্সবাদী বিপ্লবী হাসানুল হক ইনুর উচ্চারিত শহীদের প্রতি পরোক্ষভাবে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অবমাননাকর বক্তব্যের প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাই ধিক, হাসানুল হক ইনু, ধিক!

সাথে-সাথে আমি ২৩ বছর যাবৎ দুঃখিনী ও এক্ষণে অভিমানিনী মায়ের – শহীদ মিলনের মায়ের – প্রতি বলতে চাই : মা, তোমার মিলনকে আমরা ভুলিনি। মিলনের খুনির সাথে আমরা সবাই হাত মিলাইনি। আমরা মিলনের খুনিকে কখনও ‘গণতান্ত্রিক’ হিসেবে স্বীকার করবো না। এ-কথা শুধু যে আমি বলছি লন্ডন থেকে তা নয়। আমি মিলন অবমাননার সংবাদ পড়ে ফোনে কথা বলেছি শেলীর সাথে (ফকরুল আহসান, ছাত্রলীগের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রচার/সাহিত্য সম্পাদক), ইমেইল করেছি মহিউদ্দিনকে (আরিফ মহিউদ্দিন সিকদার, প্রাক্তন তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক)।

আমাদের সাহসী ও বিশাল হৃদয়ের বন্ধু শেলী ধিক্কার জানিয়েছে তার স্বভাবসুলভ রাগী কণ্ঠে। আর আমাদের সুক্ষ্ম বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধু মহিউদ্দিন লিখেছে, হৃদয় স্পর্শ করা ওর হৃদয় নিংড়ানো কথা। ওর সব কথা উদ্ধৃত করছি না, কারণ হাসানুল হক ইনু অসম্মানিত বোধ করবেন। কিন্তু ওর চিঠির শেষ লাইনটি তোমাকে জানাই মা : ‘So the way they are nwo serving AL, even by praising Ershad. I would better prefer to accept the defeat, and die by upholding the dream, rather to be a Chamcha’ (যেভাবে তারা আওয়ামী লীগের সেবা করছে এমনকি এখন এরশাদের প্রশংসা করার মধ্যদিয়ে, আমি (এ-রকম) সেবাদাস হওয়ার চেয়ে বরং স্বপ্নকে ধারণ করে পরাজয় মেনে মৃত্যুকে শ্রেয় হিসেবে গ্রহণ করবো।)

সুতরাং, দুঃখ করো না, মা। এক সময় আমরা সবাই মরবো। তোমার মিলন না হয় কয়েক দশক আগে মরেছে। মিলন ডাক্তার হয়েছিলো দেশের মানুষের জীবন বাঁচাবে বলে। সে জাসদ করতো জীবন বাঁচানোর সমাজ গড়বে বলে। সে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে গিয়েছিলো সেই সমাজ গড়ার প্রতিবন্ধকতা সরাবে বলে। কিন্তু এরশাদের ঘাতক বুলেট তোমার সেই সোনার ছেলের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

কষ্ট ধরে রেখো না মা, তোমার মিলন জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করার আগে প্রাণ হারালো, আর তার নেতা অর্থে, বিত্তে ও ক্ষমতায় ঐশ্বর্য্যপূর্ণ জীবন ভোগ করে তোমার ছেলের খুনিকে প্রশংসা করছে বলে। মিলনের মতো রাজপথে না হলেও একদিন হাসানুল হক ইনুকেও মরতে হবে অন্তত : প্রকৃতির নিয়মে। কিন্তু জেনো মা, তোমার মিলন বেঁচে থাকবে ইতিহাসে বীর হিসেবে, আর হাসানুল ইনু নিক্ষিপ্ত হবেন একই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে।

তবে আমি জানি না, জাসদের হাজার হাজার কর্মীদের মনের অনুভূতি এবং শেষ পরিণতি কী হবে। তাদের শহীদ সাথীর প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতির কী হবে? কী হবে সেই ‘প্রতিরোধে প্রতিশোধ, জাসদ! জাসদ’ স্লোগানের? হে জাসদ! কোথায় আজ তোমার প্রতিরোধ? কোথায় মিলন হত্যার প্রতিশোধ? কোথায় সেই বিপ্লবী উদ্দীপনা আর সমাজতন্ত্রের সেই বিখ্যাত উচ্চারণ : ‘আমরা লড়ছি শ্রেণি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য’? ভুল? সবই ভুল? সবাই নপুংসক? সবাই লোভী? সবাই ভীতু? সবাই কাপুরুষ? না! আমি বিশ্বাস করি না। হতেই পারে না।

এ-সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আশির দশকের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলাম আমরা যারা, তারা সবাই ‘সদ’ পরিবারের – জাসদ ও বাসদের। আমাদের জন্ম হয়েছে ১৯৭১ এর শহীদ স্বপন কুমার চৌধুরীর সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে। আমাদেরই পূর্বসূরী শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন ২রা মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের মধ্য দিয়ে; আমাদেরই পূর্বসূরী আসম আব্দুর রব স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলভবনে ৩রা মার্চে; আমাদেরই পূর্বসূরী সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ ষাটের দশক থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

হায়, আজ তাদের কেউ মৃত, কেউ বিকৃত, কেউ বিক্রিত! কিন্তু কমরেড, আইডিয়া বা চিন্তার মৃত্যু নেই। মৃত্যু নেই স্বপ্নের। আর স্বপ্ন কী, তা বলি বিজ্ঞানী আব্দুল কালামের ভাষায় : ‘স্বপ্ন সেটি নয়, যা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে; স্বপ্ন সেটি, যা মানুষকে ঘুমোতে দেয় না’। আমার ঘুম আসে না। কমরেড, আমার ঘুম আসে না। কেবলই কান পেতে শুনি বিদ্রোহী বাঙালি কবির সেই পংক্তি : ‘কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ’!

নিউবারী পার্ক, এসেক্স, ইংল্যাণ্ড

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়