শিরোনাম
◈ জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন ◈ ইরানের ইস্পাহান ও তাব্রিজে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা, ৩টি ভূপাতিত (ভিডিও) ◈ ভেটোর তীব্র নিন্দা,মার্কিন নীতি আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লংঘন : ফিলিস্তিন ◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংসদে আইন পাশ করব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক

প্রকাশিত : ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ০৪:২০ সকাল
আপডেট : ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ০৪:২০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

প্রাচ্য-প্রতীচীর পথে প্রান্তরে: তুষারপাত আর একাকীত্ব

ডঃ শোয়েব সাঈদ, মন্ট্রিয়ল : কিয়োতোতে কিছুদিন বোনের কাছে থেকে হোম সিকনেসের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামাল দিলাম। জাপানি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর ধর্মীয় আচারের তীর্থ শহর হচ্ছে ১৫ লক্ষ অধিবাসীর “কিয়োতো”- ভ্যাটিকান অব জাপান। টোকিওর আগে দীর্ঘ হাজার বছরের রাজধানী কিয়োতোকে জাপানিরা সাজিয়ে রেখেছে আভিজাত্যে, মর্যাদা আর গাম্ভীর্যে। গার্ডেন, ইম্পেরিয়াল প্যালেস, কাঠের তৈরি ঐতিহ্যবাহী ঘর-বাড়ী আর বৌদ্ধ আর শিন্টো ধর্মের বিশ্বখ্যাত মন্দির সমৃদ্ধ শহর এটি। ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যে এই শহরে উচু দালাল নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, এমনকি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত তৈরি করা হয়নি। কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় জাপানিদের প্রাইড; জাপানি নোবেল লরিয়েটদের এক তৃতীয়াংশের বেশী এই বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট। মার্কিনীদের ইচ্ছে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কিয়োতোতে আনবিক বোমা ফেলার। শহরটি নানাবিধ মর্যাদার কারণে সম্ভাব্য মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশংকায় কিয়োতোর বদলে নাগাসাকিকে টার্গেট করা হয়।

বোনের শহর থেকে ৪০০ কিমি দূরের নাগানো প্রিফেকচারে এবার আমার স্নাতকোত্তর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করার পালা। নাগানো যাবার পথে যে বুলেট ট্রেনটি চড়ে কিয়োতো থেকে নাগোয়া এসেছিলাম তার নাম ছিল হিকারি বা আলো। ঘণ্টায় ২৭০ কিমি গতিতে ছুটে চলা এই ট্রেনটি আমার প্রথম বুলেট ট্রেন অভিজ্ঞতা। পরবর্তীতে অসংখ্যবার বুলেট ট্রেনে চড়তে হয়েছে। জাপানের উত্তর থেকে দক্ষিন মোটামুটি সব কয়েকটি লাইনের বুলেট ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে অত্যাধুনিক বুলেট ট্রেন নোজমিও রয়েছে। নোজমি শব্দের অর্থ আশা বা হোপ এবং ঘণ্টায় ৩০০ কিমি গতির এই নোজমি ট্রেনটি টোকিও আর পশ্চিম জাপানের কিয়োশু দ্বীপের প্রধান শহর ফুকুওকার মাঝে চলাচল করে। ঘণ্টায় ৩০০ কিমি গতির আরেকটি বুলেট ট্রেন হায়াবুসা টোকিও থেকে উত্তর জাপানের আওমরি রুটে চলাচল করে। হায়াবুসা শব্দের অর্থ ফেল্কন পাখী। বুলেট ট্রেন নিয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রইল।

নাগোয়া থেকে বাসে করে পাহাড় আর অসংখ্য টানেল পেরিয়ে দৃষ্টিনন্দ আড়াইঘন্টার ভ্রমনে এসে পৌঁছলাম নাগানো প্রিফেকচারের শিনশু বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি অনুষদ ক্যাম্পাসে। দুটো টানেল ছিল বেশ দীর্ঘ। এর মধ্যে এনা পাহাড় ভেদ করা এনা টানেলটি ৮.৮ কিমি লম্বা। একটু ভয় ভয়ও লাগছিল। ভুমিকম্পের দেশে এখন যদি ভুমিকম্পের ফলে ভূমিধ্বস হয়, তবে নির্ঘাত জ্যান্ত কবর অথবা ভাগ্যজোরে এখান থেকেই সূচনা হতে পারে বেঁচে থাকবার দুরন্ত সংগ্রামের লোমহর্ষক কোন কাহিনীর। এই ভাবনার মাঝেই হঠাৎ দেখা গেল অনেক দূরে ক্ষীণ আলোর আভা এবং প্রতীক্ষার পর মনে হল সত্যিইতো টানেলের শেষ প্রান্তে অবধারিতভাবে আলো থাকবেই; আমাদের জীবন সংগ্রামতো এর ব্যতিক্রম নয়। পরবর্তীতে নিজে ড্রাইভ করে বহুবার পার হয়েছি এই টানেল, এমনকি পরিবার নিয়েও, ভয় লাগেনি।

পাহাড়ের খাদে কিংবা কৃষি জমিতে বিছিয়ে থাকা তুষারগুলো আমার দেখা প্রথম তুষার। কাজিন কাম ভগ্নিপতি ডঃ মাহতাব (বর্তমানে ভার্জিনিয়াতে কর্মরত চিকিৎসক) নাগানোর ইনা শহরে দুদিন থেকে আমার প্রফেসর তাকামিতসু ইউরিফুজির সহযোগিতায় আমার এপার্টমেন্টটি গুছিয়ে দিয়ে ফিরে গেলেন কিয়োতোতে। ল্যাবে কাজ শুরু করার দুদিনের মাথায় এক দুপুরে জানালা দিয়ে দেখলাম বাইরে তুলোর মত কি যেন উড়ছে। আর এটিই ছিল শিনশু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইউরিফুজির ল্যাবে গ্রীষ্মপ্রধান বাংলাদেশ থেকে আসা প্রথম ছাত্রটির তুষারপাত দেখার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা।

শুরু হল প্রবাসে একাকী জীবন। এর শুরুটাই ছিল নাগানোর প্রচণ্ড শীতে। ঋতু হিসেবে শীত বোধ হয় একাকীত্বের ভারটাকে আরেকটু বাড়িয়েই দেয়। জাপানের সাথে কানাডার পার্থক্য হচ্ছে কানাডায় বাড়ী-ঘরগুলো শীত নিরোধক হিসেবে তৈরি করা হয় আর জাপানে (হোক্কাইডো ব্যাতিরেকে) সাধারণভাবে তৈরি বাড়ী-ঘরগুলোতে শীত নিবারণের জন্যে মোবাইল হিটার, কুতাতসু বা ইলেকট্রিক্যাল ফ্লোর টেবিলের উপর মূলত নির্ভর করতে হয়। ফলে বেকায়দা শীতে ঘরের ভেতরও জড়সড় হয়ে থাকতে হতো। এরকম কঠিন সময়ে মায়ের মুখখানি খুব মনে পড়ত, মনে পড়ত ভাই-বোন সহ আশপাশের সবার স্মৃতির বিক্ষিপ্ত অংশগুলো। বয়সটা যখন ডাবল ডিজিটে পা রাখল, বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তারপর সবকিছু আগলে রেখেছেন মা, সামাল দিয়েছেন সবকিছু। পারিবারিক ঐতিহ্যে্র প্রভাবটা তাঁর ভেতর সব সময় ক্রিয়াশীল থাকতো বিধায় একটা তীব্র আভিজাত্যবোধ আত্ম-সন্মান আর আত্ম-মর্যাদাবোধের আলো ছড়াত। সেই আলোর আভায় ছেলে-মেয়ে, নাতি নাতনি সবাইকে উদ্ভাসিত হতে হয়েছে। ছোট ছেলেটি সব পরিবারেই মায়ের নেওটা থাকে বোধ হয়, আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। জাপানে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছাড়ার দিনে মা অসুস্থ হয়ে যান। আমাকে বিদায় দেবার যন্ত্রণাটি চেপে রাখতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছোট ভাই হিসেবে বা পরিবারে ছোট ছেলে হিসেবে মোটামুটি দায়িত্বশীল ছিলাম আর তাই পরিবারের সবার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হত। প্রায় সবার জীবনে একটা আনন্দময় সময় থাকে বিশেষ করে প্রথম মামা চাচা হবার সময়টা। ছোট মামা বা চাচা হিসেবে ভাই-বোনজাত পিচ্চিদের সাথে গভীর একটা মায়ার সম্পর্ক জড়িয়ে থাকতে হয় এবং আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। সেই পিচ্চিদের সবাই এখন পেশাজীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত বা প্রতিষ্ঠিত হবার পাইপলাইনে। এর মধ্যে কয়েকটি পিচ্চি এখন দেশে বিদেশে পিএইচডি বা সর্বোচ্চ একাডেমিক স্তর পার হয়ে যার যার পেশায় প্রতিষ্ঠিত হবার পাশাপাশি স্বামী সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। জাপানে আসার পরপরই আরেকটি পিচ্চির (ভাগ্নে) জন্ম হয় কিয়োতোতে। সেই সুনান ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে তরুণ অর্থনীতিবিদ হিসেবে এখন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত।

ব্যস্ততা আর ফেলে আসা স্মৃতি হাতড়ানোর মাঝেই সময় পার হচ্ছিল। ল্যাব শেষে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টের মাঝখানের নির্জন রাস্তা দিয়ে এপার্টমেন্টে ফিরতে হত। বরফে পিছলে পরার ঘটনা নেহায়েত কম নয়। হেঁটে হেঁটে বাজার করে ফেরাটি ছিল সবচেয়ে কষ্টকর। প্রথম প্রথম ল্যাবের সতীর্থরা গাড়ী দিয়ে পৌঁছে দিত। সময়ের সাথা সাথে স্বাভাবিক নিয়মে সাহায্য-সহযোগিতার এই হানিমুন সময়টি একসময় বিগত হল। বসন্তকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল সুদিনের আশায়। তুষারের সময় শেষ হতেই কিনে ফেললাম জীবনের প্রথম মাউন্টেন বাইক। বাজার করে ঘরে ফেরার কষ্টটি অনেকটাই দূর হল। আস্তে আস্তে রান্না করাও রপ্ত হয়ে গেল। ট্রায়াল এবং এররের মাধ্যমে রান্নায় সাহস বাড়তে লাগলো, সেই সাথে আইটেম। যেহেতু বোন থাকত কিয়োতোতে, লম্বা বন্ধ পেলেই বাস আর বুলেট ট্রেনে কিয়োতো যাত্রা। কিয়োতো থেকে ফিরে আবারও মন খারাপ, তবে ল্যাবের ব্যস্ততায় মনটা খারাপ কিনা তা দেখারও সময় থাকতো না। ক্রমে ক্রমে পরিচিত জনের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। ডেইরি সায়েন্সে গবেষণারত ইন্ডিয়ান ডঃ রাজার সাথে বেশ সখ্যতা ছিল। বৌদির আগমন পর্যন্ত রাজার অবসরের সময়টা আমার সাথেই বেশী কাটাতো। একদিন আমার প্রফেসর একজন বাংলাদেশী ছাত্রের চিঠি দেখালেন, আমার ল্যাবে গবেষণা করতে চায় কিন্তু তখন ল্যাবে কোন ভেকেন্সি নেই এবং কি করা যায় এই বিষয়ে আমার মত জানতে চাইলেন। আমি বললাম পাশের ল্যাবে ব্যবস্থা করা যায় কিনা। আমি জানতাম পাশের ল্যাবের প্রফেসর আমার প্রফেসরের জানের দোস্ত এবং একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ব্যস স্কলারশিপের ব্যবস্থা হয়ে গেল। আর এই একই ধারার বাংলাদেশী ছাত্রদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো ফ্যাকাল্টিতে।

শিনশু বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি ছিল মাতসুমোতু শহরে। বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী ডাক্তার ওখানে পিএইচডি করছিলেন। মাঝে মাঝে ওখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী ছাত্রদের অনুষ্ঠান হত, সেই সুত্রে বা বাংলাদেশীদের ঘরোয়া আড্ডায় মাঝে মধ্যেই মাতসুমোতু শহরে যেতে হত। সেখানে প্রথম জানতে পারি পাশের শহরেই মুন্সী আজাদ নামে বাংলাদেশী এক ভদ্রলোক থাকেন। ফোনে যোগাযোগের পরেরদিনেই আজাদ ভাই হাজির আমার এপার্টমেন্টে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ২৪ বছরের সম্পর্কটা আত্মীয়তার চেয়েও বেশী। আজাদ ভাই কাজ করতেন জেওসিভি (জাপান ওভারসিজ কোঅপারেশন ভলান্টিয়ার্স) তে। জেওসিভি হচ্ছে জাইকা বা জাপান সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন সহায়তার জন্যে ভলান্টিয়ার্স পাঠায়। আজাদ ভাই নিয়ে বিস্তারিত থাকবে আরেকটি এপিসোডে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়