বিভুরঞ্জন সরকার : সংখ্যালঘু শব্দটায় কারো কারো আপত্তি আছে। তারা মনে করেন সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু বিভাজন মানুষের মানবাধিকার ও মর্যাদার পরিপন্থি। কিন্তু কেউ স্বীকার করুন আর নাই করুন, সব দেশেই সংখ্যালঘু আছে, হতে পারে সেটা ধর্মীয়, জাতিগত, এমনকি আদর্শিক বা ভাবনা-চিন্তায়ও। সব দেশেই সংখ্যালঘুদের আলাদা কিছু সমস্যা আছে, আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। সংখ্যালঘু মনস্তত্ত্ব বলেও একটা
কথা চালু আছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। ধর্ম-নিরপেক্ষতার নীতি থেকে বাংলাদেশ সরে গেছে। ধর্ম এখন আমাদের রাজনীতির একটি বড় প্রভাবকের ভূমিকায় এসে দাঁড়িয়েছে। সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজন এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার মধ্য দিয়ে সামরিক শাসকরা যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা শুরু করেছিলেন সেটা এখন কার্যত মূলধারার রাজনীতিতে মিলেমিশে একাকার হয়েছে।
মুখে যাই বলা হোক না কেন, যতো বড়াই-ই করা হোক না কেন, বাস্তবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা সাংবিধানিকভাবেই এখন বৈষম্যের শিকার। সংখ্যালঘুদের ওপর প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে, শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা নিয়মিত বিরতি দিয়েই ঘটছে। নির্বাচন এলে সংখ্যালঘুদের মধ্যে একধরনের আশাবাদ তৈরি হয়, আবার অন্যদিকে আতঙ্কও দেখা দেয়। আশাবাদ তৈরি হয়, যদি নির্বাচিত নতুন সরকার তাদের প্রতি মনোযোগী হয়, তাদের সমস্যা সমাধানে আগ্রহী হয়, তাদের সম্পত্তি বেদখল না হয়, মন্দির ও বিগ্রহ ভাঙচুর না হয়, বাড়িঘরে হামলা-অগ্নিসংযোগ না হয়, নারীর সম্ভ্রম রক্ষা হয় এসব প্রত্যাশা জাগে। কিন্তু তাদের আশা বা স্বপ্ন পূরণের মতো বাস্তব অবস্থা তৈরি হয় না। কোনো রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের পাশে বা পক্ষে থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে না। তবে ভোট চায় সবাই। আশ্বস্ত করে না, শাসায়। ভোট ঠিকমতো না দিলে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এই ‘ঠিক মতো ভোট’ ব্যাপারটা কি? সংখ্যালঘুরা যাকেই ভোট দেবে সেটাই বেঠিক হবে। এ-কে দিলে বি-র কাছে, বি-কে দিলে এ-র কাছে।
গত কয়টি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সংখ্যালঘুদের জন্য সুখকর হয়নি। ভোটের আগে-পরে তারা আক্রান্ত হয়েছে। জান-মালের ক্ষতি হয়েছে। অপরাধীরা চিহ্নিত হলেও বিচারের মুখোমুখি হয়নি। নিরাপত্তাহীনতায় অনেকে এলাকা, এমনকি দেশ ছাড়াও হয়েছেন। আগামী নির্বাচন কি সংখ্যালঘুদের জন্য নতুন আতঙ্কের কারণ হবে? বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোরের বেশ কয়েকজন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে খুব উজ্জ্বল চিত্র পাওয়া গেলো না। তারা আতঙ্কে আছেন। কেউ ভোটের সময় এলাকায় না থাকার কথা ভাবছেন। কেউ ভাবছেন, সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধের কথা। আবার কেউ বলছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণা জমে উঠলে বোঝা যাবে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। হিন্দু এলাকাগুলোতে বিএনপি-জামায়াত প্রচার করছে, এবার তারা ক্ষমতায় আসছে।
ক্ষমতায় এসে এবার দেশ হিন্দুশূন্য করা হবে। ২০০১ সালের চেয়ে ভয়াবহ হবে পরিস্থিতি করা হবে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পথ চিরদিনের মতো বন্ধ করার জন্য যা করা দরকার তাই করা হবে। সাতক্ষীরায় গত পাঁচ বছরে হিন্দু জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেকে এসে ঠেকেছে। শ্যামনগর উপজেলায় হিন্দু ভোটার ১ লাখ ৩৯ হাজার। এই এলাকার মানুষের মধ্যে চাপা আতঙ্ক। তারা ভোট দিতে পারবেন তো? আওয়ামী লীগের ওপরও হিন্দুরা ভরসা করতে পারছেন না। সাতক্ষীরায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর কয়েকটি হিন্দু এলাকায় আক্রমণ হয়েছিলো।
আক্রমণকারীরা এখন আওয়ামী লীগে ঢুকেছে, আশ্রয় পেয়েছে। নির্বাচনে তাদের ভূমিকা কী হবে? একজন জানালেন, আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপিরা জামায়াতকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে এরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে বলে মনে হয় না। হিন্দুরা এখন বুঝতে পারছেন না, কার কাছে গেলে তারা নিরাপত্তা পাবেন। প্রশাসন কতোটা দৃঢ়তা দেখাবে, নির্বাচন কমিশনেরই বা ভূমিকা কি হবে সেটাও তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তাই মানুষের মনে ভয় আছে। ভয়কে জয় করার প্রত্যয় নেই। লেখক : গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন