শাহীন চৌধুরী : তিতাসে কর্মকর্তা কর্মচারীদের বদলি, চাকরিচ্যুতিসহ নানা ভাবে শুদ্ধি অভিযান চালালেও যেন প্রতিষ্ঠানটি এখনো কাঙ্খিত লক্ষে পৌছাতে পারছে না। এই প্রতিষ্ঠানের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার হার দেখলেই বোঝা যায় কী বিপুল পরিমাণ অবৈধ সংযোগ তিতাসে রয়েছে। গত নয় মাসে শিল্প, বাণিজ্যিক, ক্যাপটিভ, আবাসিক চুলা মিলিয়ে মোট ১ লাখ ৫০ হাজার ৬৬০টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এরমধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৮৬টিই আবাসিকের অবৈধ চুলা। এছাড়া ৭৭টি শিল্প সংযোগ, ৭৮টি বাণিজ্যিক সংযোগ এবং ১৯টি ক্যাপটিভের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে তিতাস। সংযোগ ছাড়াও এই নয় মাসে ৫৭১ দশমিক ৩ কিলোমিটার পাইপলাইন উচ্ছেদ করেছে তিতাস। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
অবৈধ সংযোগ নেই এইমর্মে চলতি বছরের পয়লা মার্চের মধ্যে এই ঘোষণা আসার কথা ছিল। তবে, এখন বলা হচ্ছে, অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা চলতেই থাকবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, উচ্চমূল্যের এলএনজি এখন বিনা পয়সায় ব্যবহার করবেন অবৈধ ব্যবহারকারী। আর বৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীরা হবেন তার বলি।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, এই বছরের জুন থেকে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু পাইপলাইনের নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় চট্টগ্রামের বাইরে এলএনজি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন আনোয়ারা-ফৌজদারহাট পাইপলাইনের নির্মাণ কাজ শেষের পথে। এখন চলছে সংযোগ দেয়ার কাজ। চলতি নভেম্বরের মধ্যেই এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে। কিন্তু এর আগেই অবৈধ ব্যবহারকারী মুক্ত করার কথা ছিল। এই প্রসঙ্গে তিতাসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এখনও নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভারে তিতাসের গ্যাস চুরি করে ব্যবহার করছেন অনেকে। আমরা দিনে পাইপ লাইন তুলে ফেললে আবার রাতেই তা বসে যায়। স্থানীয় প্রভাবের কাছে অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়তে হচ্ছে।
তিতাস গত জুনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য যে হিসাব দিয়েছে, তাতে গত তিন বছরেই সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে। এরমধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৯৪ ভাগ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ দশমিক ৭১ ভাগ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ দশমিক ২৬ ভাগ সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে। দেশের মোট গ্যাসের ৫৭ দশমিক ২৬ ভাগই তিতাস বিতরণ করে। বিভিন্ন কারণে অন্য কোম্পানির সিস্টেম গেইন হলেও তিতাসে সিস্টেম লস নিয়ে ওই সময় প্রশ্ন তোলা হয়। বলা হয়, এই সিস্টেম লসের পুরোটাই অবৈধ ব্যবহারকারীরা চুরি করেন।
গত জানুয়ারি মাসে ৯টি শিল্প, ৮টি বাণিজ্যিক, ১টি ক্যাপটিভের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে ৫টি শিল্প, ১০টি বাণিজ্যিক, ৫টি ক্যাপটিভ ছাড়াও ৫৩ দশমিক ৭৪ লাইন কিলোমিটার পাইপলাইন এবং ২০ হাজার ৯৭০টি অবৈধ আবাসিক চুলার লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়। মার্চ মাসে ৭টি শিল্প, ২১ বাণিজ্যিক, ১টি ক্যাপটিভ, ৬৯ দশমিক ২০ কিলোমিটার গ্যাসের পাইপলাইন এবং ২৬ হাজার ৫৩৩টি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
এপ্রিল ১৫টি শিল্প, ১৩টি বাণিজ্যিক, ২টি ক্যাপটিভ, ১টি সিএনজি, ২৮২ দশমিক ৮১ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস পাইপলাইন এবং ৭৩ হাজার ৩০টি চুলা সংযোগ বিচ্ছিন্নকরা হয়। মে মাসে ৬টি শিল্প, ৬টি বাণিজ্যিক, ১টি ক্যাপটিভ, ৭৭ দশমিক ৩ কিলোমিটার লাইন, ২৯ হাজার ৯৫৩টি চুলার, জুন ও জুলাই মাসে ১৩ শিল্প, ৪টি বাণিজ্যিক, ৩টি ক্যাপটিভ, ৩৪ দশমিক ৪৪ কিমি লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়। এরপর আগস্ট মাসে ২টি শিল্প, ৩৮ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার লাইন এবং সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে ২০টি শিল্প, ৬টি ক্যাপটিভ, ১৬টি বাণিজ্যিক এবং ১৫ দশমিক ৫৫ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস পাইপলাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
সূত্রমতে, বর্তমানে তিতাসের গ্যাসের চাহিদা প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। অন্যদিকে এলএনজি আসায় চট্টগ্রামে এখন ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। কর্ণফুলী রিভার ক্রসিংয়ের কাজ শেষ হলে এই গ্যাসের কিছু অংশ ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। তবে এর আগে অবৈধ সংযোগ মুক্ত ঘোষণা দিতে বিতরণ কোম্পানিটি ব্যর্থ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিতাসের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মশিউর রহমান বলেন, আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অভিযান একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যতদিন অবৈধ সংযোগ থাকবে, ততদিন এই অভিযান চলতেই থাকবে। তিনি বলেন, অনেক সময় পাইপলাইন তুলে ফেলার পর আবার লাইন বসিয়ে ফেলে। ফলে বার বার মোবাইল কোর্ট নিয়ে যেতে হয়। অবৈধ সংযোগ পুরোপুরি নির্মূল করতে অনেক সময় লাগবে। প্রায় ৯০ শতাংশ অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে তিতাস।
প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, অবৈধ সংযোগ বন্ধে তিতাস ধারাবাহিক ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আগের তুলনায় কম কিনা, তা সংখ্যা বলা সম্ভব নয়। তবে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বন্ধের সব রকম চেষ্টা করা হচ্ছে। শিগগিরই আমরা অবৈধ সংযোগমুক্ত হতে পারবো।
আপনার মতামত লিখুন :