শিরোনাম
◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন, নিয়ন্ত্রণে ১২ ইউনিট ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত : ১৭ নভেম্বর, ২০১৮, ১০:৫০ দুপুর
আপডেট : ১৭ নভেম্বর, ২০১৮, ১০:৫০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মজলুম জনতার কণ্ঠস্বর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

ইসলাম ডেস্ক : মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার সয়াধানগড়া গ্রামে এক বনেদি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। ভাসানীর ডাকনাম চেগা মিয়া। পাঁচ বছর বয়সে মক্তবে ওস্তাদের কাছে তার পড়াশোনার হাতেখড়ি। ছয় বছর বয়সে তার বাবা মারা যান এবং মাত্র ১২ বছর বয়সে মা মৃত্যুবরণ করেন। পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর পাঁচ বছরের মধ্যে দুই ভাই এক বোন এবং মা মারা যান। হয়ে পড়েন ভাগ্যহত এতিম। মওলানা ভাসানী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন পাননি। মক্তবের পাঠ সমাপ্ত করেছিলেন এবং নিজ প্রচেষ্টায় উর্দু-ফারসি, হিন্দি, অসমিয়া, আরবি ও ইংরেজি ভাষা শেখেন।

বাবা বেঁচে থাকতেই ময়মনসিংহের কল্পা গ্রামে ভাসানীকে পাঠানো হয়েছিল পীর সৈয়দ নাসিরুদ্দিন বোগদাদীর কাছে। তাঁর সংস্পর্শে ভাসানী দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে ছিলেন। বোগদাদী সাহেবের মুসাফির খানায় হককুল্লাহ ও হককুল এবাদ মিশনের কাজ জোরেশোরে চলতে থাকে। ভাসানী ছিলেন তার একজন যোগ্য সাগরেদ। বোগদাদী সাহেব ‘বড় হুজুর’ এবং ভাসানী ‘ছোট হুজুর’ হিসেবে পরিচিত হলেন। তখন থেকে মওলানা ভাসানী মাথায় তালের টুপি ব্যবহার করা শুরু করেন এবং আজীবন এটা করেছেন।

মওলানা ভাসানী ১৯০৮ সালে আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৫ সালে আসাম আঞ্জুমান ওলামার সভাপতি এবং ১৯১৬ সালে আসাম কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালে তিনি বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে পদার্পণ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মওলানা আজাদ সুবহানী, মওলানা আবুল কালাম আজাদের সংস্পর্শে আসেন রাজনীতির সূত্রে।

মওলানা ভাসানী জমিদারপ্রথাবিরোধী সংগ্রামে সাধারণ মানুষের আপনজন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এই আন্দোলনের ফলে গণবিরোধী জমিদাররা ভীত-সন্ত্রস্ত হন। এ কারণে তাকে বাংলাদেশ ছাড়তে হয় এবং আসামে গিয়ে উঠতে বাধ্য হন। ২৪ বছরের তরুণ মওলানাকে সেখানে বাস্তুহারা বাঙালি জনগোষ্ঠী নেতা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাঙালি অভিবাসীদের ব্যাপারে ঘোষিত ‘লাইন প্রথা’র বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৩১ সালে আবদুল হামিদ ছিলেন ভাসানচরের স্থায়ী বাসিন্দা। ভাসানচরে অসামান্য অবদানের জন্য তার সমধিক খ্যাত নাম হলো ‘ভাসানী’।

১৯৩৭ বন্যাপ্লাবিত টাঙ্গাইলে ভাসানী আসেন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে। ‘ঘাঁটি’ করেন কাগমারীতে। শুরু করলেন নতুন সংগ্রাম। এলাকার মুসলমান রায়তদের পক্ষ থেকে দাবি তুললেন সন্তোষের জমিদারির ওপর অধিকার। কাগমারীতে হজরত শাহজামানের মাজারে মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেও সন্তোষের জমিদারদের চক্রান্তে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের আদেশে বহিষ্কৃত হয়ে আসাম ফিরে যেতে বাধ্য হন। ৩৫ বছর বয়সে বগুড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে আলেমা খাতুনকে তার পীরের নির্দেশে বিয়ে করেছিলেন। বগুড়ার বীরনগরের প্রভাবশালী জমিদার কন্যা আলেমা খাতুন মওলানা ভাসানীর মৃত্যুঅবধি তার পাশেই ছিলেন। এ ছাড়া আরো দু’বার দ্বার পরিগ্রহ করেছেন ভাসানী। সে স্ত্রীদের অকাল মৃত্যু হয়েছে।

আসামে ১৩ বছরের প্রবাস জীবনে আট বছর কারাগারে কেটেছে ভাসানীর। বাঙালিদের প্রতিনিধি হিসেবে আসাম প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য ছিলেন ১১ বছর। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রস্তাবের ওপর তদানীন্তন টাঙ্গাইল মহকুমায় তিনি নিখিলভারত মুসলিম লীগের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ফলে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে বিপুল ভোট পড়েছিল। ১৯৪৮ সালে আসামের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেন মওলানা। সন্তোষে আস্তানা গড়ে সেখানে ছিলেন শেষ পর্যন্ত। তিনি ছিলেন আপসহীন ও ক্ষমতার লোভমুক্ত সংগ্রামী নেতা। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে মত পেশ করে সময়োপযোগী এবং অগ্রগামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মতো দূরদর্শিতার জন্য তিনি জাতীয় নেতা হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছেন। ১৯৪৮ সালে শুরু থেকেই তিনি ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

১৯৪৯ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে আসেন। এ সময় মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। সে বছর ১১ অক্টোবর ঢাকার আরমানীটোলা ময়দানে জনসভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কথা ঘোষণা এবং মুসলিম লীগের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন। ১৬ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯৫০ সালে জেলে তার অনশন ধর্মঘট চলাকালে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে মিলিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ’৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয় ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে হারিয়ে। ১৯৫৫ সালে তিনি কৃষক সমিতি গঠন করেন। ১৯৫৭ সালে বহুলালোচিত ও ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। পরের বছর সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে ভাসানীসহ বহু নেতাকে অন্তরীণাবদ্ধ করেন। ভাসানী ১৯৬৪ সালে সার্বজনীন ভোটাধিকারের আহ্বান জানান। গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। ভাসানী ছিলেন এ আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক।

১৯৬৮ সালে শেষ দিকে মওলানা ভাসানী আয়ুইববিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে পরিণত করেন। এর পরিণামে ১৯৬৯ সালে সংঘটিত হয় গণঅভ্যুত্থান। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব গদি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন আন্দোলনের চাপে।

১৯৭০ সালে মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। ’৭০ সালের নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণের তীব্র নিন্দা করেছিলেন। ৪ ডিসেম্বর তিনি পল্টনের জনসভায় প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সালে ৯, ১০, ১১ ও ১২ মার্চ মোমেনশাহী, খুলনা ও রাজশাহীর বিশাল জনসভাগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।

আসামে থাকাকালে সেখানে ৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন ভাসানী। বগুড়াতে হাজী মুহম্মদ মহসীন কলেজ, পাঁচবিবি উচ্চবিদ্যালয়, রংপুরে একটি উচ্চবিদ্যালয়, টাঙ্গাইলে বিন্নাফৈর হাইস্কুল ও মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ এবং তার জীবনের শেষ সৃষ্টি সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে স্কুল কলেজসহ ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত। ‘শিক্ষা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরজ’- ইসলামের এই শাশ্বত বাণী তিনি সারা জীবন মনেপ্রাণে বাস্তবায়ন করেছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আরো অনেকের মতো মওলানা ভাসানী ভারতে চলে যান এবং তাকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি করা হয়। স্বাধীনতার পর ফিরে এসে ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল পল্টনের জনসভায় চোরাচালানের বিরুদ্ধে তিনি আপসহীন মনোভাব ব্যক্ত করেন। এ সময় সৈয়দ ইরফানুল বারীর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক হক কথা পত্রিকা প্রকাশ করেন যা ছিল খুব জনপ্রিয় পত্রিকা। ১৯৭৪ সালে বাংলার মানুষের দরদি বন্ধু, আপসহীন মওলানা ভাসানী অনশন শুরু করেন সরকারের দায়িত্বহীনতা, দেশে আইনশৃঙ্খলাহীনতা ও দুর্ভিক্ষের প্রতিবাদে। তখন আন্দোলন করতে গেলে তাকে গৃহবন্দী করা হয়।

চীন, মিসর এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মওলানা ভাসানী সফর করেছিলেন। মাও সে তুং, চৌ এনলাই, জামাল নাসেরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন নেতার সঙ্গে তার ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত কর্তৃক আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার এবং ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে অশীতিপর এই নেতা ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলের নেতৃত্ব দান করেন রাজশাহী থেকে কানসাট পর্যন্ত।

১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ৯৬ বছর বয়সে সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব, মজলুম জনতার কণ্ঠস্বর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ইন্তেকাল করেন। টাঙ্গাইলের সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে তিনি চিরনিন্দ্রায় শায়িত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়