মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : একাদশ জাতীয় সংসদ নিবন্ধন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের এবার প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছুকের সংখ্যা বেশ বেশি হবে- এটি আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল। তবে সেটি যে এতো বেশি হবে তা দলও ভাবতে পেরেছে কিনা জানি না। নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর পরই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের আবেদনপত্র জমা দেওয়ার তারিখ নির্ধারিত হলে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকায় চলে আসতে শুরু করেন, তারা দলের ধানমন্ডিস্থ অফিসে আবেদনপত্র সংগ্রহ ও জমাদানে ঝাপিয়ে পড়েছেন। প্রথম দিনেই ১ হাজার ৭০০ প্রার্থী আবেদনপত্র সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে। দ্বিতীয় দিনও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
জানা গেছে প্রায় প্রতিটি আসন থেকেই ব্যাপক সংখ্যক নেতা এবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন। তাদের এই আকাক্সক্ষা মোটেও নেতিবাচকভাবে দেখার বিষয় নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একটি আসনে যদি এতো ব্যাপক সংখ্যক নেতা প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং তারা যদি সত্যি সত্যি দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর সমস্যা সৃষ্টি করেন তাহলে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিজয় অনেকাংশেই সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। এটি যদি মোট আসন সংখ্যার দিক থেকে বেশি হয় তাহলে তো দলের পরাজয়ের আশংকা বাড়িয়ে দিতে পারে। বিভিন্ন মিডিয়ায় নির্বাচনী হালচালের খবরাখবর প্রচারিত হয়ে আসছে। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় প্রতিটি আসনেই বেশ কয়েকজন মনোনয়ন পেতে ইচ্ছুক নেতা নিজেদের সম্পর্কে আশাবাদী বক্তব্য প্রদান করছেন। তারা অনেকেই এটিও দাবি করেছেন যে, তিনি মনোনয়ন পেলে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসনটি দলের সভাপতিকে উপহার দিতে সক্ষম হবেন। অবশ্য একই ধরনের বক্তব্য বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিরও কেউ কেউ দিয়েছেন। তাদের এ ধরনের দাবি কতোটা বাস্তবসম্মত সেটি এলাকার ভোটাররা ভাল জানেন, দল কতোটা জানেন তা জানি না। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিদিন এ ধরনের বিজয়ী হওয়ার দাবি ব্যক্ত করে যারা বক্তব্য দিচ্ছেন তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে তারা তাদের বিজয় সম্পর্কে আগে থেকেই নিশ্চিত, প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কেউ হলে কী হবে সেটি অবশ্য তারা বলেননি। ফলে নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইচ্ছুকদের বক্তব্য শ্রোতারা কতোটা আগ্রহ ভরে শোনেন- সেটি অবশ্য একটি বড় প্রশ্ন। এখন আওয়ামী লীগে মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এটি দলের জন্যে এক ধরনের বাড়তি জটিলতা ও চাপ সৃষ্টি করবে বলে মনে হচ্ছে।
প্রার্থীদের তালিকা বাছাই করা, তাদের সাক্ষাৎ নেওয়া এবং মনোনয়ন দেওয়া না দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে তাদেরকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামানো সব জায়গায় একরকম হবে না। কোনো কোনো আসনে হয়তো সমস্যা বড় আকার ধারণ নাও করতে পারে। কিন্তু কোনো কোনো আসনে পরিস্থিতি বেশ জটিল হতে পারে। বিশেষত যেসব আসনে দলীয় নেতাদের পারস্পরিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন বিরোধপূর্ণ ভাবে চলে আসছে। সেখানে কে কাকে কতোটা ছাড় দেবেন সেটি বেশ জটিল প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ গত দুইবার পর পর ক্ষমতায় থাকায় অনেকের মধ্যেই এমপি হওয়ার স্বপ্ন বেড়ে গেছে, আবার কোনো কোনো এমপি নিজ নিজ আসনে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে কাজ করেননি আবার দলকেও সেভাবে পরিচালিত হতে সাহায্য করেননি। ফলে এ ধরনের এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে আছে। আবার কোনো কোনো আসনে কোনো কোনো নেতা দলীয় শৃংখলা ও নিয়মকে তোয়াক্কা না করে নিজের ভিন্ন একটি বলয় তৈরি করেছেন। এ ধরনের অবস্থা অনেক আসনেই রয়েছে। মুখে অনেকেই সেকথা স্বীকার না করলেও বাস্তবে এক নেতার সঙ্গে অন্য নেতার সাপে-নেউলে সম্পর্ক। সেইসব আসনে দলীয় অবস্থানকে খুব বেশি শক্তিশালী হতে দেয়নি। জনগণের মধ্যেও দলের প্রসার ঘটেনি। মন্ত্রি, এমপি এবং নেতাদের বিরোধ সর্বস্তরে ছড়িয়েছে। এ ধরনের বেশ কিছু আসন রয়েছে। জানি না এসব আসনের প্রার্থী চূড়ান্তকরণ শেষ পর্যন্ত কীভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিষ্পত্তি হবে তা দেখার বিষয়।
অন্যদিকে জোট এবং মহাজোটগতভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত অনিবার্য হয়ে গেলে অনেক আসনেই জটিলতা বাড়বে। বিশেষত মহাজোটের জাতীয় পার্টি বেশি আসন লাভের জন্য যেভাবে দরকষাকষি করছেন তাতে কিছু কিছু আসন বেশ ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এইসব জটিলতা আগামী ১৯ তারিখের আগে নিষ্পন্ন করার দায়িত্ব দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার উপর পড়তে যাচ্ছে। সবাই আশা করছেন তিনি হয়তো তার দৃঢ়তা এবং ক্যারিশমা দিয়ে নিষ্পত্তি করতে পারবেন। দলে এখন তার নির্দেশ অমান্য করার সাহস তেমন কারো নেই। তবে প্রতিটি আসনে যোগ্য, গ্রহণযোগ্য এবং বিজয়ী হয়ে আসার মতো প্রার্থী চূড়ান্ত করা এবং মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে অন্যদেরকে মাঠে নামানো খুবই জরুরি বিষয়। মনে রাখতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নের দুর্বলতা ও ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করবেই। সেক্ষেত্রে আগে থেকেই প্রার্থী মনোনয়ন দানে সব কূল রক্ষা করা মোটেও সহজ কাজ হবে না। তারপরও আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষীদের ধারণা শেখ হাসিনা এবার আমলনামা পর্যালোচনা করেই অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকেই মনোনয়ন দিতে সক্ষম হবেন।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাউবি
আপনার মতামত লিখুন :