সেলিম জাহান : ৮ নভেম্বর বোধহয় ভাইফোঁটা ছিলো। মনে ছিলো না, এই প্রবাসে মনেও থাকে না, কিন্তু সেতারের ছড়ের একটি টঙ্কারের মতো মনে পড়ে যায়। পরানের অতল গহীন থেকে নানা স্মৃতিরা উঠে আসে বুদ্ধুদের মতো। ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে তারা কথা কয়’ রক্তের ভেতরে। বিকেলের ডিমের কুসুমের মতো যে নরম রোদ- তারই মতো কতো কথার উত্তাপ ছড়িয়ে যায় মনের আঁকে-বাঁকে। যে রাস্তায় আমাদের বাড়ি, তার মুখের ডানদিকের বাড়িটিই ছিলো আমার সহপাঠী রাখালদের। লতুদি রাখালের বড়বোন। খুবই লক্ষ্মী মেয়ে ছিলেন আমার দিদি। পাড়ার ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে সবাই লতু’দিকে ভালোবাসতেন ওর নরম স্বভাবের জন্য। লতুদি ভারী ভালোবাসতেন আমাকে একেবারে রাখালের মতোই। মনে আছে, ভাইফোঁটার দিন ডাকতেন আমাকে -রাখালের পাশে বসাতেন আমাকেও। আসন পাততেন দুজনের জন্যেই। আসন-পিঁড়ি হয়ে বসতাম দুজনে। লতুদি আমাদের মাথার ওপর মঙ্গল প্রদীপ আর ধান-দুর্বার ডালা ঘুরিয়ে নিতেন, মুখে উচ্চারণ করতেন, ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা’।
ওই শব্দ কটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চোখ ছাপিয়ে জল আসতো আমার। তখন মনে হতো, পৃথিবীর কোনো অমঙ্গলই আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। মুখে তুলে দিতেন মিষ্টি। তারপর প্রণামীর ভঙ্গিতে এগিয়ে ধরতেন ধুপসহ কাপড় – এক প্রস্থ রাখালের, অন্য প্রস্থ আমার। এক জিনিস, এক রঙ – কোনো তফাৎ ছিলো না তাতে।
আমি লতুদিকে প্রণাম করতে গেলে দুহাত দিয়ে ধরে ফেলতন। ভারী নরম গলায় বলতেন, ‘থাক্, থাক্, বড় হও ভাই’। আজ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের, ‘কেউ কথা রাখেনি’র মতো বলতে ইচ্ছে করে, ‘লতু’দি, অনেক তো বড় হয়েছি, আর কতো বড় হবো আমি?’
লতুদি যেমন ছিলেন নরম-সরম, আমার অনিতাদি ছিলেন তেমনই ডাকাবুকো। আমার সহপাঠী তপনের বড় বোন। শান্ত তো ননই মোটে- বরং সবটাতেই আমার এ দিদিটির বেশ একটা মারমার,কাটকাট ভাব। তাকে এক জায়গায় দু’ মিনিটের বেশি স্থির থাকতে দেখেছে, এ তার অতি বড় শত্রুও বলতে পারবে না। লতুদি যদি হন মা দুর্গা, অনিতাদি তাহলে নির্ঘাত মা কালী।
তপনরা থাকতো বেশ কিছুটা দূরে – শহরের অন্য প্রান্তেই বলা চলে। কিন্তু অনিতাদির কড়া নির্দেশ ছিলো, সন্ধ্যার আগে গিয়েই পৌঁছুতে হবে। মনে আছে,প্রতিবারই দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় গিয়ে হাজির হলেও বলতেন, ‘দেরি করেছিস লেট লতিফ’। তারপরই চলে যেতেন কক্ষান্তরে। হাঁপাতে হাঁপাতে ভারী রাগ হতো দিদির ওপরে নিষ্ঠুরও মনে হত মাঝে মধ্যে। কিন্তু তারপর যখন অনিতাদি আমাদের আসনের সামনে বসতেন, মঙ্গল প্রদীপ আমার মাথার ওপরে ঘোরাতেন, ভারী মৃদু কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ করতেন, তখন কেমন এক কমনীয়তার আভা ছড়িয়ে পড়তো তার চোখে-মুখে। কপালে তার লাল টিপ, মিহিদানার মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম তাঁর নাকের ডগায়, ফর্সা মুখে মায়া ছড়ানো – তন্ময় হয়ে যেতাম। ঘোর ভাঙতো যখন তিনি দ্রুত উঠে যেতেন তপন আর আমার জন্য খাবার আনতে।
স্মিতহাস্যে ভারী নরম চোখে তপন তাকাতে আমার দিকে। এক অদ্ভুত ভালো লাগা তির তির করে কাঁপতে থাকতো আমাদের দুজনের মধ্যে। তপন চোখ ফিরিয়ে নিতো হয়তো উদগত অশ্রু চাপতে। আমিও ঝাপসা দেখতাম যখন খাবারের থালার সঙ্গে সঙ্গে আমার জন্য বরাদ্দ দিদির ভাষায়, ‘তেষ্টার যুগ্যি গেলাসটা’ নামিয়ে রাখতেন আমার সামনে।
মনে আছে, তখন আমরা বেশ বড় হয়েছি খুব সম্ভবত কলেজে পড়ি। অনিতাদিকে প্রণাম করে উঠতেই, যখন তিনি এগিয়ে দিয়েছিলেন উপহার, দুহাত বাড়িয়ে সেই স্নেহের দান গ্রহণ করতে করতে আমি বলেছিলাম, ‘তোমাকেও তো আমাদের কিছু দেয়া দরকার। ভাইদের তো খালি হাতে আসতে নেই’। পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ভারী নরম গলায় অনিতাদি বলেছিলেন, ‘দিও একদিন। তোমাদের দেয়া তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, ফুরিয়েও যাচ্ছে না’।
না, অনিতাদি, তুমি ঠিক কথা বলনি সেদিন। পালিয়েও গেছে অনেক কিছু, ফুরিয়েও গেছে বহু জিনিস। এই যে লতুদি আর তুমি তো পালিয়ে গেলে আমার জীবন থেকে। কোথায় আর পাবো তোমাদের মনের মধ্যে শুধু গুনগুনিয়ে উঠে ‘বনে যদি ফুটলো কুসুম, নেই কেন সেই পাখি, নেই ই কেন, নেই কেন সেই পাখি’?
ফুরিয়েও তো গেছে আমাদের হিরন্ময় দিনগুলো- যখন ধর্মের ভিন্নতা পেরিয়ে আমার একটা মানবিতার ফসল ঢাকা মাঠে একে অন্যের হাত ধরেছিলাম। আমি তোমাদের ‘দিদি’ ডাকতে পেরেছো অক্লেশে, তোমরাও তে রাখাল-তপনের থেকে আমাকে আলাদা ভাবনি? যখন মঙ্গল প্রদীপ ঘুরিয়েছো আমার মাথার উপরে, তখন তোমাদের স্নেহের ঝর্ণাজল যেমন বয়ে গেছে আমার কপালে, আমার তো মনে হয়েছে তোমাদের শুভ কামনায় কোনো অমঙ্গলই আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কোথায় গেলো সেই সময় ‘কেঁদেও কি পাবো না তাকে এই বর্ষার অজস্র জলাধারে’?
লেখক : অর্থনীতিবিদ, ইউএনডিপিতে কর্মরত
আপনার মতামত লিখুন :