বিভুরঞ্জন সরকার : আমি এটা ধরে নিতে চাই যে, আগামী ২৩ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং অবশ্যই এই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নির্বাচিত হবেন না। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। তাই নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক। তবে নির্বাচন কতোটুকু অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে নাকি অসমতল মাঠেই খেলতে হবে, সেসব বিষয়ে এখনই কোনো চূড়ান্ত মতামত দেয়া যাবে না বা দেয়া ঠিক হবে না। তবে নির্বাচনী তৎপরতায় আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি পিছিয়ে আছে এবং এই অবস্থা মেনে নিয়েই তারা লড়াইয়ে অবতীর্ণ হচ্ছে। জয়ের জন্য লড়ে পরাজয় মেনে নেয়ার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে।
নির্বাচনে জয়-পরাজয় নয়, আজ মনোযোগ দিতে চাই অন্যকিছু বিষয়ের প্রতি। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী হিসেবে কাদের মনোনয়ন দিচ্ছে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলো কি যেনতেন উপায়ে নির্বাচনে জেতাটাকেই অগ্রাাধিকার দেবে, নাকি রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য ভালো প্রার্থী, সৎ প্রার্থী ও যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেবে? আওয়ামী লীগ মনোনয়নপত্র বিক্রি করছে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে সংসদ সদস্য হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা ঝাঁকে ঝাঁকে মনোনয়নপত্র কিনছেন। মনোনয়নপত্রের দাম পঁচিশ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ত্রিশ হাজার টাকা করা হয়েছে। তাতে কারো উৎসাহে ভাটা পড়েছে বলে মনে হয় না। এটা পঞ্চাশ হাজার বা এক লাখ টাকা করা হলেও আগ্রহী প্রার্থীর অভাব হতো না। আওয়ামী লীগের সভাপতির কার্যালয় এখন যেমন জমজমাট তখনও তেমনই থাকতো।
বিএনপিসহ অন্য দলগুলো এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেনি। বিএনপি অফিস এখনও জনবিরল। তবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানালে বিএনপি অফিসও মানুষের পদভারে কম্পমান হবে। আওয়ামী লীগের মতো না হলেও বিএনপিতেও টাকাঅলা প্রার্থীর অভাব হবে না। তবে অন্য ছোট দলগুলোকে গরিবি হালেই হয়তো ভোটপর্ব সারতে হবে।
মনোনয়ন দান চূড়ান্ত হলেই বোঝা যাবে, কারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছেন। রাজনীতির চেনামুখ, বিতর্কিত মুখ, নাকি নবাগত এবং ক্লিন ইমেজের কেউ? প্রার্থী মনোনয়ন থেকেই বোঝা যাবে, কেমন সংসদ আমরা পেতে চলেছি। আগামী দিনের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে, নাকি একই ধারায় চলবে সব কিছু।
প্রশ? হলো, কোথায় কোথায় পরিবর্তন দেখতে চাই আমরা?
আমরা প্রথমেই নিশ্চয়ই চাইবো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সমতাভিত্তিক উন?ত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। প্রশ? আসতে পারে, এখনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায়, তাহলে দেশ কি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে চলছে না? এই প্রশে?র সহজ উত্তর হলো ‘না’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে আমরা বিচ্যুত হয়েছি। ধর্মকে রাজনীতির একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সশস্ত্র জঙ্গিবাদী সংগঠন বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করেও সক্রিয় থাকছে। আগামী নির্বাচনের পর কি অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমাজে বিকশিত করার জন্য কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক উদ্যোগ দেখা যাবে?
আমাদের সমাজে যে সামাজিক অবক্ষয়, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের উল্লাসনৃত্য দেখা যাচ্ছে; তা থেকে কি আমরা আগামী নির্বাচনের পর বেরিয়ে আসার কোনো পথ পাবো?
দুর্নীতি-সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত অল্পসংখ্যক মানুষ। কিন্তু তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন সমাজকে। এই ক্ষমতাবানদেরই যদি আগামী নির্বাচনেও ক্ষমতায়িত করা হয়, তাহলে ভোট নিয়ে খুব আশাবাদী হওয়ার কিছু থাকবে কি? রাষ্ট্রক্ষমতায় দল বদলানোর আগ্রহ আমাদের যতো প্রবল, নীতি বদলে ততোটাই অনাগ্রহ।
আমাদের দেশের রাজনীতি মূলত সংঘাতমূলক। বিশেষত প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির অবস্থান সহযোগিতামূলক নয়, বিদ্বেষমূলক। ক্রমাগত বিভিন? ঘটনায় দুই পক্ষের দূরত্ব বেড়েছে। রাজনীতি বছরের পর বছর আবর্তিত হচ্ছে দুজন মানুষকে কেন্দ্র করে । শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তই এখন পর্যন্ত রাজনীতির শেষ কথা। তাদের মধ্যে পরস্পর কথা বলার সম্পর্ক নেই। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। পরস্পরকে জানা এবং না-জানার মধ্যে তফাৎ আকাশ-জমিন। কথা না বলে যাকে অনেক ভয়ঙ্কর বা দূরের মানুষ মনে হয়, কথা বললে হয়তো দেখা যাবে, আসলে ও-তো আমার মতোই মানুষ।
এই যে গণভবনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হলো, এর কি কোনো তাৎপর্য নেই? এটা কি একেবারে নিষ্ফলা সময়ক্ষেপণ মাত্র? আমার মনে হয়, আপাত ‘সিদ্ধান্তহীন’ এই আলোচনা আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির সিদ্ধান্তগ্রহণে কিছু না কিছু প্রভাব অবশ্যই ফেলবে।
আসলে দেশ চলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। যে কোনো পরিবর্তনেরই সূচনা করতে পারে রাজনীতি তথা রাজনৈতিক দল তথা রাজনৈতিক নেতৃত্ব। রাজনৈতিক দলগুলো সমাজে সংগঠিত শক্তি। তারা চাইলেই কেবল কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন নির্বাচনে জেতা, ক্ষমতায় যাওয়া এগুলোই হয়ে গেছে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য। অথচ এক সময় রাজনীতিবিদরা দেশসেবার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি করতেন, জেল খাটতেন, কষ্ট করতেন, কিছুই পেতেন না। তবু দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করার সন্তুষ্টি নিয়েই তারা রাজনীতি করতেন।
এখন রাজনীতি বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। দেশের উন?তি হচ্ছে, কেউ হয়তো না খেয়ে থাকছেন না; খালি পা, খালি গায়ের মানুষ হয়তো নেই। কিন্তু সমাজে ধনবৈষম্য বাড়ছে উৎকটভাবে। পাকিস্তান আমলে আমাদের লড়াই ছিলো বাইশ পরিবারের বিরুদ্ধে। এখন হয়তো সেরকম বাইশ হাজার পরিবার হয়েছে।
আগামী নির্বাচনে যারা জয়লাভ করবেন তাদের অবস্থান হবে কোন পক্ষে? স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ? ছিলো ‘বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। আগামী নির্বাচনে যারা বিজয়ী হবেন তারা কি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে নেবেন? নাকি নিজেরাই শুধু হাসবেন? সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব
আপনার মতামত লিখুন :