প্রতীতি শিরিন : ভারতে পরকীয়া আর অপরাধ নয়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ আমলে করা ভারতীয় দণ্ড বিধির ৪৯৭ ধারাকে অসাংবিধানিক বলে এক যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। এই ধারা অনুযায়ী, এতোদিন ভারতে পরকীয়া ছিলো অপরাধ। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ঐতিহাসিক রায় দিলেন দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। এর আগে, গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় দ-বিধির ৩৭৭ ধারাকে বাতিল করে, সমকামিতাকে অপরাধ নয় বলে রায় দেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। এই দুই আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে আবারো একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে গেলো, আর তা হলো- এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের প্রতিবেশি দেশটি বিশ্বের সাথে তাল মেলানোর অবিরাম চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার নিরিখেই ৪৯৭ ধারাটি বাতিল করা হয়েছে। ঐ ধারা অনুযায়ী, কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীর অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে শারীরিক ও মানসিক সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, তাহলে স্বামী ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারতেন। তবে পরকীয়ার জন্য স্ত্রীর কোন শাস্তি হতো না। রায়ের সময় এই ধারার বেশ কয়েকটি সমস্যা তুলে ধরা হয়। প্রথমত, পরকীয়ার জন্য স্ত্রীকে দায়ী করা হতো না। এছাড়াও স্ত্রীকে স্বামীর সম্পত্তি বলে গণ্য করা হতো। বিষয়টি এমন ছিলো যে- স্বামী তার সম্পত্তিহানির জন্য অপর ব্যক্তিকে সাজা দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কোন অবিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে আইনটি প্রযোজ্য ছিলো না। এছাড়া বিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রেও আইনটির প্রয়োগ ছিলো না। বিবাহিত পুরুষ অন্য কোনো নারীর সাথে জড়ালে সেটা পরকীয়া হিসেবে ধরা হতো না। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হতো না। তৃতীয়ত, স্ত্রী যদি স্বামীর অনুমতি নিয়ে অন্য পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়ান; তাহলে তা পরকীয়ার আওতায় পড়তো না, যা আসলে ছিলো হাস্যকর।
যুগান্তকারী এই রায় ঘোষণা করেছেন ভারতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র। সমকামিতাকে অপরাধ নয় বলেও রায় দিয়েছিলেন তিনি। রায় ঘোষণার সময় তিনি বলেন, এই ধারা অনুযায়ী, বিয়ের পবিত্রতা নষ্ট করা হয়েছে। যার মাধ্যমে মানসিক মিল না হলেও দু’টি নারী-পুরুষকে জীবনভর শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার করতে হয়। সুপ্রিম কোর্ট ধারাটিকে অসাংবিধানিক বলেছেন, কারণ স্বামী তার স্ত্রীর প্রভু নয়। এছাড়া ভারতীয় সংবিধান অনুয়ায়ী, একজন নারী বা পুরুষের তার নিজের শরীরের ওপর অধিকার রয়েছে। একমাত্র সম্মতির ভিত্তিতেই দু’জন নারী-পুরুষের শারীরিক মিলন হতে পারে। দীপক মিশ্র বলেছেন, নারীকে হেয় করার যে কোনো আইনই সংবিধানপরিপন্থী। সংবিধান অনুযায়ী, নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অধিকার। নাগরিক হিসেবে তারা সব ক্ষেত্রেই সমান অধিকার পাওয়ার যোগ্য। পরকীয়া কোনভাবেই ফৌজদারি অপরাধ হতে পারে না। কেবল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে করা কোন অপরাধই ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তবে পরকীয়ার জন্য যে কেউ বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারে বলেও জানান তিনি। বিবাহের পূর্বশর্তই হলো, দুটি নারী-পুরুষের মধ্যে বিশ্বাস। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে শুধু আইনের ভয়ে এক সাথে থাকা বিবাহের মতো বিশ্বস্ত ও বৈধ চুক্তির মর্যদাহানিই করে বরং।
প্রতিবেশী দেশটির কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি আমরাও। বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমলে তৈরি অনেক আইন বাতিল তো দূরের কথা সংস্কারই হয়নি। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ শাসন করছে প্রায় দু’শো বছর। তখনকার প্রেক্ষাপটে ঐ সময়ে তৈরি করা আইনগুলো এই সময়ে যে প্রযোজ্য হবে না, তা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট উপলব্ধি করতে পেরেছে। বাংলাদেশের বিচারপতিদেরও এই উপলব্ধি দরকার যে, পুরনো কিছু কিছু আইনের আসলেই পরিবর্তন দরকার।
এছাড়া নিষেধের বেড়াজালে কোনো দেশের কোন উন্নয়নই সম্ভব নয়। সৌদি আরবের মতো রক্ষণশীল দেশ পর্যন্ত তা উপলব্ধি করতে পারছে। আর তাইতো সেখানে নারীদেরকে কিছু কিছু অধিকার দেয়া শুরু হয়েছে। এর মধ্যে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতিদান অন্যতম। সৌদি আরবকে আধুনিক করার পদক্ষেপ নেয়ায় ৩২ বছর বয়সী সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান অবশ্যই অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। এর আগে, তিনি এক মন্তব্য করেছিলেন যে, নারীরা বোরখা পড়ে বাইরে যাবেন, নাকি শুধু মাথা ঢেকে জনসম্মুখে বের হবেন, তা তার নিজস্ব ব্যাপার। যদিও বিচার ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনায় তার এই মন্তব্যকে তিনি কার্যকর করতে পারেননি। তারপরও এই মন্তব্য সৌদি বিচার ব্যবস্থার ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত। তবে যে কোন পরিবর্তনের জন্য আসলে আইনি সংস্কারই সবার আগে দরকার। আইনি সংস্কার ছাড়া কোন দেশেরই উন্নয়ন সম্ভব নয়। সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব
লেখক পরিচিতি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
আপনার মতামত লিখুন :