শিরোনাম
◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী 

প্রকাশিত : ০৩ নভেম্বর, ২০১৮, ০৩:৪৮ রাত
আপডেট : ০৩ নভেম্বর, ২০১৮, ০৩:৪৮ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

দেবেশ রায়ের উপহার

শাশ্বত জামান : প্রথম ভারত-ভ্রমণ স্মরণীয় হয়ে থাকবে যে কয়েকটা কারণে, তার মধ্যে বিশেষ একটা কারণ হলো কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়ের সান্নিধ্য লাভ। কলকাতায় যাওয়ার আগে দেশে থাকতেই কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়ের সঙ্গে দেখা করবো ঠিক করেছিলাম। কিন্তু এই ইচ্ছে শুধুমাত্র ইচ্ছেই থেকে যেতো যদি না আমার শুভাকাক্সক্ষী, সম্পূর্ণ অন্য একটা জগত থেকে লিখালিখি ও চলচ্চিত্রের জগতে আমাকে নিয়ে আসা, পশ্চিমবঙ্গের লেখক এবং সম্পাদক সুশীল সাহা দাদা পাশে না থাকতেন। মনের ইচ্ছের কথা তাঁকে জানালাম। তিনিই দেবেশ রায়ের বাড়িতে আমাকে এবং আমার ভ্রমণসঙ্গী সুব্রত বিশ^াসকে নিয়ে গেলেন। সাথে আরো ছিলো আমার ওপার-বাংলার লেখক ও প্রকাশক বন্ধু বিষ্ণু সরকার।

২৯ আগস্ট ২০১৮, বারাসাতের হৃদয়পুরে সুশীল দা’র বাড়ি থেকে আমরা চারজন রওনা হলাম কলকাতার দিকে। দাদা বললেন, ‘আমরা বাসে যাবো। তাহলে সুবিধা হবে।’ ভারতে গিয়ে প্রথম কয়েকদিন দূরের যাত্রায় ট্রেনে চড়েছিলাম। এবার সুযোগ হলো বাসে চড়ার, যশোর রোড দিয়ে কলকাতায় যাওয়ার।

সকাল এগারোটার দিকে বাস থেকে বাগুইআঁটি নামলাম। সেখান থেকে দেবেশ দা’র বাড়ি হাঁটা পথের দূরত্ব। পথে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশ দেখছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম, কী কথা বলা যায় দাদার সাথে। তবে আমাদের একটি বড় ভুল হয়েছিলো। আমাদের রূপসা লিটল-ম্যাগের কিছু কপি নিয়ে গিয়েছিলাম কলকাতার পরিচিত ও শুভাকাক্সক্ষীদের দেওয়ার জন্যে। কিন্তু সেদিন সঙ্গে নিতে ভুলে গেলাম একদম। নিজেদের পত্রিকা দেবেশ দা’কে দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হলো।

দেবেশ দা’র বাড়িতে প্রবেশ করেই আমরা দেখলাম বসার ঘরে শুধু বই আর বই। তিনি তখন ভেতরে ছিলেন। বাড়ির একজন গিয়ে তাঁকে আমাদের আসার খবর দিলেন। এই ফাঁকে সুশীল দা’ বললেন, “দেবেশ দা’ এখন একটু অসুস্থ, বয়স হয়েছে তো। কানেও ঠিক মতো শুনতে পান না। তবে আমার কথা বেশ ভালোই বোঝেন। দীর্ঘদিনের চেনা-জানার ফলেই এমনটা হয়েছে। তোমদের কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে লিখে ওঁনার কাছে দেবে।”

দেবেশ দা’ একদম ঘরোয়া পরিবেশে এলেন। এসেই বললেন, ‘কয়েকদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।’

সুশীল দা’ আমাদের দেখিয়ে বললেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আমার দুই ভাই এসেছে আপনাকে দেখতে। আর বিষ্ণু আমাদের এখানের ছেলে। হাবড়ায় থাকে।’ দেবেশ দা’ বেশ ভালোই বুঝলেন সুশীল দাদার কথা। তিনি বললেন, ‘আমার বাংলাদেশের ভিসার কী খবর বলো তো?’

সুশীল দাদা বললেন, ‘ভিসার কাগজ বাংলাদেশ হাই-কমিশনে জমা দিয়েছি। আর বলবেন না, বাংলাদেশের ভিসা পেতে গেলে এখন খুব বেগ পেতে হয়। তবু আমার একটি পরিচিত ছেলে আছে, সে করে দিচ্ছে বলে সহজে পারছি।’

দেবেশ দা’ অক্টোবরে রাজশাহীতে একটি কবি-সমাবেশে যোগ দিতে চান। এজন্যে বাংলাদেশের ভিসা করাতে দিয়েছিলেন সুশীল দা’র কাছে, যা শুনে দেবেশ দা’র বাড়ির লোকজন একটু অবাকই হলেন। কারণ, এই বয়সে তাঁর একা চলাচল করা বেশ কঠিন। বিষ্ণু একটা বই উপহার দিলো। তাদের প্রথম বাংলাদেশ ভ্রমণের ওপরে দুই ভাই মিলে লিখেছে বইটা। বেশ সময় নিয়ে বইটা পড়লেন তিনি। এরপর আমাকে ও সুব্রতকে একটি করে শুভেচ্ছা-স্মারক লিখে দিলেন। একদম চিঠির মতো করে। এবার বিদায়ের পালা। আমরা দেবেশ দা’র আশীর্বাদ নিয়ে রওনা হলাম কবি শঙ্খ ঘোষ দাদার বাড়িতে। যেতে যেতে সুশীল দাদা আমাদের জানালেন, “তোমাদের সৌভাগ্য! এতো সময় নিয়ে, খুব সুন্দর করে তোমাদের শুভেচ্ছা স্মারক লিখে দিলেন দেবেশ দা’। এমনটা সচরাচর ঘটে না।”

বিষয়টি কালি লেপনের - ব্যক্তির মুখে তো অবশ্যই, সেই সঙ্গে দেশের ও জাতিরও। সাম্প্রতিক সময়ে দু’টো ঘটনায় ঐ চুন-কালির ব্যাপারটি আবার মনের দরজায় কড়া নাড়ল - অনেকটা ঐ ‘অবনী বাড়ী আছো?’ গোছের। প্রথম বিষয়টি ইতিবাচক - কোন এক সময়ে লেপিত কলঙ্কের মোচন, দ্বিতীয় বিষয়টি কিন্তু নেতিবাচক - নতুন করে চুন-কালি লেপন।

প্রথম বিষয়টি শোনা গেল আজই - রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। খবরটা শেনা মাত্র দু’টো অনুভূতি হদয়ের আনাচে-কানাচে ছলাৎ ছলাৎ করে বইতে লাগল - ‘আহ্, অবশেষে..’ এবং ‘জয় বাংলা’। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা খুব পরিষ্কার - স্বাধীনতা-বিরোধী, মানবতা-বিরোধী, ধর্ম-নিরপেক্ষতা বিরোধী। সুতরাং যুদ্ধাপরধের জন্য জামায়াতের শাস্তির বদলে আশির দশকে এ হেন একটি অপশক্তিকে বাংলাদেশের মাটিতে সমর্যাদায় পুনর্বাসিত করলেন তৎকালীন শাসকেরা। জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী নেতারা মন্ত্রী হলেন, যে বাংলাদেশের বিরোধিতা তারা করেছিলেন, সে দেশটির পতাকা শোভিত সরকারী গাড়ীতে ক্ষমতার দম্ভে তারা সদর্পে বিচরন করতে লাগলেন এই বাংলাদেশের মাটিতেই।

সেদিন হিমালয় সদৃশ এক বিশালাকায় কলঙ্ক লেপিত হয়েছিলো আমাদের প্রত্যেকের মুখে, দেশের কপালে, জাতির কপোলে। একটি ন্যাক্কারজনক অসম্মান ও তাচ্ছিল্য দেখানো হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি, এ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি, যাঁরা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন বা সম্ভ্রম খুইয়েছেন, তাঁদের প্রতি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে সেই কলঙ্ক মোচনের যে প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছিল, আজ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের মাধ্যমে সেই লেপিত কালি আরো অনেকখানি অপসারন করতে পারলাম আমরা জাতি হিসেবে।

কিন্তু কালিমা মোচনের এ সুখসংবাদ চন্দ্রগ্রহণের রাহুর মতো ঢাকা পড়ে যায়, যখন দেখি যে ধর্মঘটের নামে কালি লেপিত হচ্ছে নিরীহ মানুষের মুখে, গাড়ীতে, বাসে এবং অন্যান্য যানবাহনে। কিন্তু সে কালিমা তো একজন মানুষের মুখে সীমাবদ্ধ থাকছেনা, ছড়িয়ে পড়ছে দেশের কপালে, জাতির কপোলে। লুণ্ঠিত হচ্ছে ব্যক্তি মানুষের সম্মান, দেশের ভাবমূর্তি, জাতির অহংকার।

এই পুরো প্রক্রিয়ায় অপশক্তির কাছে শুধু যে পরাভব মানছে মানুষের সম্মান, নিরাপত্তা আর স্বাচ্ছন্দ্য তাই নয়, মানুষের জীবন জিম্মি হয়ে পড়েছে তার কাছে। তাই তো দেখি অসুস্হ রোগী রাস্তায় পড়ে আছে - নেয়া যাচ্ছে না তাদেরকে হাসপাতালে, সেবার অভাবে জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হচ্ছে কচি শিশুর - কিন্তু তবু নারকীয় শক্তির মানবতা জেগে উঠছে না

এই তান্ডবের, এই অরাজকতার, এই নাশকতার শেষ কোথায়? আমরা সবাই কি শিকার হতেই থাকব এই সব পাশবিক প্রক্রিয়ার? আমরা কি মধ্যযুগীয় বর্বরতার পূজারী হয়ে গেছি? পেশীশক্তিই কি আমাদের একমাত্র জীবন-উপকরন হয়ে গেল? নিমর্মতার জীবন-বোধই কি আমাদের দর্শন, সন্ত্রাসই কি আমাদের একমাত্র ভাষা?

‘তবু পাশবিকতা নাহি মানে পরাভব ‘ - এটাই কি আমাদের মেনে নিতে হবে?

আমাদের মুখে, দেশের কপালে, জাতির কপোলে কালিমা আমরাই লেপন করতে পারি আমাদের দুষ্কর্ম দ্বারা, আবার সেই কালিমা আমরাই মোচন করতে পারি আমাদের সুকর্মের দ্বারা। সিদ্ধান্তটা আমাদেরই - দু:স্বপ্নটাকে আমরা যাতে দু:সময় না হতে দেই।

‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ, তারাই বেশি দেখে কোন কিছু ছাড়া;

যাদের হৃদয়ে বিন্দুমাত্র প্রেম-ভালেবাসা নেই,

পৃথিবীকে নিমিষে অচল করে দিতে পারে তারা।’

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়,

মহৎ সত্য বা রীতি কিংবা মানবতা অথবা প্রীতি

জেগে যেন ওঠে তারা, হয় যেন শুধু তাদেরই জয়।’

(ঈষৎ পরিবর্তিত)

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়