মহিউদ্দিন খান মোহন : সাদা স্কুল বা কলেজড্রেস পরা মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে অসহায় দৃষ্টি মেলে। ওর পোশাকে লেগে আছে ছোপ ছোপ কালির দাগ। হতভম্ব মেয়েটির চোখের দৃষ্টি দেখেই বুঝা যায় বিস্ময়ে সে বিমূঢ় হয়ে গেছে। হয়ে গেছে বাকশক্তি রহিত। বিস্ময়ভরা চোখে যেন তার প্রশ্ন -এ কোন সমাজে সে বাস করছে? ওর পূর্বপুরুষগণ কি এমন একটি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, জীবন দিয়েছিলেন? সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন লাখ লাখ নারী? কে জানে হয়তো ওই মেয়েটির পূর্বপুরুষদের কেউ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানী ছিলেন কিংবা হয়েছেন শহীদ। আজ তাদেরই এক উত্তরসূরীকে সেই স্বাধীন দেশে ‘দাবি আদায়ের আন্দোলনে’র অমানবিক শিকারে পরিণত হতে হয়েছে! গত রবিবার পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘটের প্রথম দিনে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একজন লাঞ্ছিত ছাত্রীর ওই ছবি সর্বত্র নিন্দা-ঘৃণার ঢেউ তুলেছে।
শুধু ওই একটি ছবিই নয়, আরো অনেক ছবি বেরিয়েছে ওইদিনের পৈশাচিক ঘটনার। প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে বেরুনো চালক-আরোহীদের মুখম-লে মেখে দেওয়া হয়েছে পোড়া মবিল। মবিলমাখা বিষন্ন মুখগুলো দেখে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়েছেন সচেতন ব্যক্তি মাত্রই। সবার প্রশ্ন- এ কেমন প্রতিবাদ, এ কেমন আন্দোলন? সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাস হওয়া পরিবহন আইনের প্রতিবাদে আটচল্লিশ ঘণ্টার এ ধর্মঘট ডেকেছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন;যার কার্যকরি সভাপতি সরকারের একজন মন্ত্রী। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন ধর্মঘট সম্পর্কে তিনি নাকি কিছুই জানেন না। এর চেয়ে আজগুবি খবর আর কী হতে পারে! যে সংগঠন ধর্মঘট ডাকলো তার শীর্ষ নেতা সে সম্পর্কে কোনো খবর রাখেন না, তা কি বিশ্বাসযোগ্য? শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা অনেকেই করেন। কিন্তু তা যে সফল হয় না, এটা যারা সে চেষ্টা করেন তারা বুঝতে চান না।
ধর্মঘট ডাকা যেমন কোনো শ্রমিক সংগঠনের অধিকার, তেমনি তা মানা না মানার অধিকারও দেশবাসীর রয়েছে। আমাদের সংবিধানই দেশের নাগরিকদের সে অধিকার দিয়েছে। পাশাপাশি জোর জবরদস্তি করে কোনো কিছু মানতে বাধ্য করার চেষ্টাও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। পরিবহন শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন-ধর্মঘট করবে করুক। কারো কিচ্ছু বলার নেই। কিন্তু তা করতে গিয়ে নাগরিকদের হেনস্তা করবে কেন? কোথায় পেল তারা এ দুঃসাহস? এতবড় অপরাধ সংঘটনের সাহস তারা পায় কার কাছ থেকে? গোটা জাতিকে জিম্মি করে তাদের এই তা-ব কী বরদাশত করার মতো?
প্রশ্ন আরো আছে। যখন ওই বর্বরোচিত ঘটনাগুলো ঘটেছে, তখন আশপাশে পুলিশও ছিল। কিন্তু তারা শ্রমিক নামের ওই দুর্র্বৃত্তদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে নি। যেখানে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ মিছিল দেখলেই পুলিশ রে রে করে ছুটে আসে, সেখানে দিন দুপুরে কতগুলো সন্ত্রাসীর (এদেরকে আমি শ্রমিক বলতে নারাজ) এহেন কার্যকলাপ দেখেও তারা চোখ বুঁজে থাকলো কার ইশারায়?
ওইদিন একটি টিভি চ্যানেলের খবরে ওসমান আলী নামের একজন পরিবহন শ্রমিকনেতার বক্তব্য শুনলাম। তিনি এক পর্যায়ে বললেন যে, দেশে এমপি মন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো শর্ত নাই, সেখানে ড্রাইভারদের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত দেওয়া হচ্ছে কেন? যারা টিভি’র ওই খবর দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন ওসমান আলী কী রকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলেছে সাক্ষাতকারে! তার হাবভাবে মনে হচ্ছিল সে দেশের কাউকেই তোয়াক্কা করে না। কেন মন্ত্রী এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত নেই সে কৈফিয়ৎও তাকে দিতে হবে! এ ঔদ্ধত্যের রাশ যদি এখনই টেনে ধরা নাহয়, তাহলে আগামীতে আরো ভয়ঙ্কর ঘটনা যে ঘটবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আরো একটি শোকাবহ ঘটনা ঘটে গেছে সেদিন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখায়। গুরুতর অসুস্থ নবজাতক একটি শিশুকে বহনকারি এ্যাম্বুলেন্সকে যেতে দেয়নি ধর্মঘটী শ্রমিকরা। সে শিশুটি ওই এ্যাম্বুলেন্সেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। বেপরোয় এবং দুর্বিনীত ওই শ্রমিকদের কারণে যে ফুলটি না ফুটতেই ঝরে গেল, তার দায় কে নেবে? এটা কি হত্যাকাণ্ড নয়? এ হত্যার জন্য যারা দায়ী তারা কী আইনের আওতায় আসবে?
শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের আন্দোলনের বিরোধিতা কেউ করছে না। তাদের আন্দোলন তো সরকারের বিরুদ্ধে। তাহলে নীরিহ মানুষ কেন তাদের আন্দোলনের অসহায় শিকার হবে? তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এসব ঘটনা দেশের সীমানা পেরিয়ে নিমিষেই ছড়িয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখেছে, বাংলাদেশের পরিবহন শ্রমিকরা নীরিহ মানুষদের ওপর কী রকম বর্বরতা চালাচ্ছে। বলা নিষ্প্রয়োজন, তা আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমাদের দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করবে সঙ্গত কারণেই। যে কালি সেদিন ওরা মাখিয়েছে ছাত্রীর পরনের কাপড় আর নীরিহ মানুষের মুখে, তা যেন কালিমালিপ্ত করেছে জাতির মুখম-লকেই! এ লজ্জা আমরা ঢাকব কী দিয়ে?
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কিবশ্লেষক।
আপনার মতামত লিখুন :