মতিনুজ্জামান মিটু: অপার সম্ভাবনা নিয়ে ফিরে এসেছে বিলুপ্তপ্রায় তিতির পাখি। আগের মতোই গ্রামাঞ্চলে দেশি মুরগীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে এই পাখির দলকে। দুই হাজার টাকার পাখি এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় ধরা দিয়েছে তিতির পাখির এই সাফল্য।
বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হওয়ার অপার সম্ভাবনা থাকলেও ১০/১২ বছর আগে হুমকির মুখে পড়ে তিতির পাখি। আইসিইউএন তিতিরকে আশঙ্কাহীন ঘোষণা করলেও বাংলাদেশে এরা ছিল প্রায় বিপন্ন। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণি আইনেও এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
অনেকটা মুরগির মতো হলেও এটি আসলে পাখি। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এই পাখি চায়না বা চীনা মুরগি হিসেবে পরিচিত। প্রায় ৭০০ বছর আগে বন-জঙ্গলের এই প্রাণি গৃহপালিত পাখি হিসেবে পালন করা শুরু হয়। আফ্রিকার এই পাখিটি ইংরেজদের হাত ধরে ইউরোপ থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় আসে। ৪০০ বছর আগে থেকেই বাংলাদেশে তিতির পাখি পালন হয়ে আসছে।
এনএটিপি (ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলোজি প্রোজেক্ট) ফেজ-২ এর একটি উপপ্রকল্পের মুখ্য গবেষক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) এর পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সুবাস চন্দ্র দাস বলেন, তিন দশক আগেও তিতির পাখিকে দেশের গ্রামাঞ্চলে দেশি মুরগির সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখা যেত। ১০ থেকে ১২ বছর আগে হঠাৎ করেই এই পাখি আর দেখা যেত না। সেসময় এই পাখি গ্রামাঞ্চলে নয়, ঢাকার কাটাবনে খাঁচায় দেখা যেত। আর সেই খাঁচার প্রতিটি তিতির পাখি বিক্রি করা হতো ২০০০টাকায়।
আমাদের দেশে আগে বিশ্বের ৩ ধরণের মধ্যে পার্ল বা মুক্তা রং এর তিতির পাখি পালন করা হয়ে আসছিল। বর্তমানে ইউরোপ থেকে সাদা ও লেভেন্ডার (হালকা বাদামি) রং এর তিতির পাখি এনেও পালন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশি মুরগির মতই এদের লালন-পালন করা যায়। এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য পাখির তুলনায় বেশি। সংক্রমণ বা পরজীবী সহজে আক্রান্ত করতে পারে না। আলাদা কোনো ভ্যাকসিন বা ওষুধও দিতে হয় না। এমনকি তিতিরের সম্পূরক খাদ্যের চাহিদাও কম। প্রতিকুল পরিবেশেও এরা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। দেশি মুরগি যেখানে ৬ মাসে সর্বোচ্চ ১ কেজি ওজনের হয় সেখানে তিতির পাখি দেড় কেজি বা তারও বেশি হয়ে থাকে। তিতিরের ডিমের খোসা অত্যন্ত শক্ত, শারীরিক বৃদ্ধির হার বেশ ভালো এবং মাংস অনেক সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হয়। তিতির পাখি বছরে ১৪০ থেকে ১৬০ টি ডিম দিয়ে থাকে।
মাংস ও ডিমের চাহিদা পূরণই শুধু নয়, দেশের জীববৈচিত্র রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে এ পাখি। এছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এখানেও এরা ফসলের শত্রুপোকা খেয়ে হোম গার্ডেন বা পারিবারিক বাগানের ফসল রক্ষা করতে পারে। সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, ময়মনসিংহ ও ঢাকার আশপাশসহ সারা দেশেই ব্যাক্তিগতভাবে এবং কোনো ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে তিতির পাখি পালন করা হচ্ছে। আগের সেই হতাসাজনক পরিস্থিতি এখন আর নেই। রাজধানী ঢাকার কাপ্তান বাজার ও টঙ্গি বাজারে সপ্তাহে ২ দিন এ পাখি বিক্রি করা হচ্ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিভাগের খামারে তিতির পাখি ও তিতির পাখির বাচ্চা বিক্রি করা হয়। এ পাখি পালন দেশি মুরগির চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক। তিতির পাখির বাজার দাম দেশি হাঁস-মুরগির চেয়ে অনেক বেশি। তাই এটি পালন দেশি মুরগির চেয়েও লাভজনক। ফলে তিতির পাখি পালন দারিদ্র বিমোচনে সহায়তা করতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এনএটিপি ফেজ-২ এর একটি উপপ্রকল্পের আওতায় তিতির পাখির পালন, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।