ভোরের কাগজ : যাত্রা শুরুর মাত্র কয়েকদিনের মাথায়ই চরম আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে গঠিত এ জোটটির ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে অনিশ্চিয়তা। যে ৭ দফা দাবি ও ১১টি লক্ষ্য পূরণের আশাবাদ নিয়ে এ জোটটির গঠিত হয়, তার অনেকটাই দুরাশায় পরিণত হয়েছে। জনে জনে ঐক্য, ঘরে ঘরে ঐক্য জোটটির এ স্লোগানটিও আর ধোপে টিকছে না।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৩ অক্টোবর শনিবার। শুরুর দিনই বিকল্পধারা ও যুক্তফ্রন্ট সভাপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে নিয়ে সৃষ্ট নাটকে তৈরি হয় নানা বিতর্ক। এরপর বিতর্ক ডালপালা ছড়ায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে কেন্দ্র করে। সেনাবাহিনী প্রধানকে নিয়ে বিতর্কে জড়ান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আর সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে বেকায়দায় পড়েন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। তারেক রহমানের নেতৃত্ব প্রশ্নে জনৈক রব মজুমদারের সঙ্গে ব্যারিস্টার মইনুলের টেলিফোন কথোপকথনও বিএনপি নেতাকর্মীদের মর্মাহত করে। যা গোটা জোটকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
ঐক্য প্রক্রিয়ার এই দুই দিকপালকে নিয়ে সারা দেশ যখন কৌত‚হলী, তখন অনেকটাই শীতল থাকেন জোটটির প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন। এমনকি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ফোন করে ড. কামালকে তার পক্ষে একটি বিবৃতি দিতে অনুরোধ করলে এতেও অস্বীকৃতি জানান ড. কামাল। ফলে প্রচণ্ড ক্ষেপে যান ব্যারিস্টার মইনুল। বিষয়টি নিয়ে ফোন করে অভিযোগ করেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে। এ সময় মইনুল ও জাফরুল্লাহ উভয়ই কামালকে কাওয়ার্ড (কাপুরুষ) বলে সম্মোধন করেন। একপর্যায়ে মইনুল বলেন, আমি আর ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে নেই। তিনি বলেন, আমি না থাকলে কীসের ঐক্যফ্রন্ট। দুই নেতার টেলিফোনে এ কথপকথন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। যা ড. কামালের ওপর মইনুল ও জাফরুল্লাহর আস্থাহীনতার প্রমাণ দেয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। এর আগে রব মজুমদারের সঙ্গে আরেক টেলিফোন সংলাপে ব্যারিস্টার মইনুল বলেন, তারেকের নেতৃত্ব ধ্বংস করার জন্যই আমরা ঐক্যফ্রন্ট তৈরি করেছি।
অন্যদিকে গত ২৪ অক্টোবর বুধবার সিলেটে ঐক্যফ্রন্টের প্রথম সমাবেশে ড. কামাল ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদের বক্তব্য নিয়েও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে। দলটির অধিকাংশ নেতা ক্ষুব্ধ এ দুই নেতার কর্মকাণ্ডে। সিলেটের সমাবেশে খালেদা জিয়ার মুক্তি পর্যন্ত দাবি করেননি ড. কামাল। অধিকন্তু নিজেকে বঙ্গবন্ধুর কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন তিনি। কামাল বক্তব্য শেষ করার পর একজন নেতা যখন তাকে কানে কানে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করতে বলেন তখন তিনি বলেন, খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দাবি করছি যা আমাদের ৭ দফা দাবির ১ নম্বর দফা। মনসুর তার বক্তব্য ‘জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে শেষ করেন।
সমাবেশের ব্যানারে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কোনো ছবি ছিল না। তারেক রহমানকে নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের কোনো নেতা কোনো বক্তব্য রাখেননি। তার মামলা প্রত্যাহারের দাবি তো দূরের কথা। এমনকি ওই সমাবেশে ঐক্য প্রক্রিয়ার মাস্টারমাইন্ড কারাবন্দি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মুক্তি পর্যন্ত দাবি করেননি কেউ। অথচ ঐক্য প্রক্রিয়া তৈরির পেছনে ব্যারিস্টার মইনুলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র ডা. জাফরুল্লাহ তার বক্তব্যে মইনুলকে হয়রানি করা হচ্ছে বলে তার দায়িত্ব সেরেছেন।
বিষয়গুলো সিলেটের স্থানীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সারা দেশের নেতাকর্মীদের নজর কেড়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করেন, সিলেটসহ সারা দেশে ঐক্যফ্রন্ট বলতে বিএনপিকেই বোঝায়। এখন পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের সব কর্মসূচি বিএনপিই সফল করেছে। আগামীতেও বিএনপিই সব কর্মকাণ্ড সফল করবে। ঐক্যফ্রন্টের বাকি দল গণফোরাম, জেএসডি কিংবা নাগরিক ঐক্যের কোনো নেতাকর্মীকে ওইসব কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। অথচ বিএনপির হাইকমান্ড এখানে উপেক্ষিত থাকেন। তারেক রহমানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এমন কথা বলা হয় মঞ্চ থেকে।
উপরন্তু জয়বাংলা, জয়বঙ্গবন্ধু স্লোগান শোনানো হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের। মঞ্চে উপস্থিত বিএনপির সিনিয়র নেতাদেরও অবমূল্যায়ন করা হয় ঐক্যফ্রন্টে। দলটির নেতাদের মতে, আওয়ামী লীগের স্লোগান শোনার জন্য কি তারা সমাবেশে হাজির হন। যা ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কতদিন টিকবে ঐক্যফ্রন্ট- এ প্রশ্নও ইতোমধ্যে উচ্চারিত হতে শুরু করেছে বিএনপির মধ্যে। এ কারণে বিএনপির একটি অংশ নিষ্ক্রিয়ও হয়ে রয়েছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের এমন আশংকা দিন দিন ভিত্তি পাচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদেরই কর্মকাণ্ডে। এই সন্দেহ-অবিশ^াসের মধ্যে নতুন জোটটিকে কতদূর যাবে সে প্রশ্ন এখনই আলোচিত হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। জোট গঠনের প্রাক্কালে সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন জোট গঠন হলেও তা বেশিদিন টিকবে না। ওবায়দুল কাদেরের সে বক্তব্যই কি শেষ পর্যন্ত সঠিক হতে চলেছে? এ নিয়ে ড. কামাল হোসেন ইতোমধ্যেই বলেছেন, কেউ কেউ আমাদের এ প্রচেষ্টা দেখে ক্ষমতায় যাওয়ার ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। আমরা প্রকাশ্যে সভা করছি, কোনো গোপন বৈঠক করছি না। যারা জনগণের শক্তিকে ভয় পায়, তারা জনগণের সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টাকে ষড়যন্ত্র বলে জনগণকেই অপমান করছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের লক্ষ্য গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা, মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনা। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশে একটি কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র নির্মাণ করা। যত বিতর্কই থাকুন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।
আপনার মতামত লিখুন :