মো.সাদ্দাম হোসেন, ঠাকুরগাঁও : দেশের লোকশিল্প যখন বিলুপ্তের পথে, তখন ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্ত এলাকার আত্মপ্রত্যয়ী ফাতেমা পাপোস তৈরির কারখানা গড়ে তুলে নিজে হয়েছেন স্বাবলম্বী। অন্যদেরও আয়ের পথ দেখিয়েছেন সংগ্রামী এই নারী। সংগ্রামী ও আত্মপ্রত্যয়ী এক নারীর নাম ফাতেমা বেগম।
অতিসাধারণ হয়েও তিনি এখন অসাধারণ। যার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার ৫’শ পরিবার।
গ্রামে স্কুল ছিলোনা । বাড়ি হতে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে একটি স্কুল অবস্থিত। পাড়ার কেউ যেতোনা ওই স্কুলে। সঙ্গী-সাথীর অভাবে ফাতেমারও স্কুল যাওয়া হয়নি।
তের-চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয় ফাতেমার । স্বামীর সংসারেরও অবস্থা ভালো ছিলোনা। বিয়ের দুই বছরের মাথায় পুত্র সন্তানের মা হন ফাতেমা। এরপর আরেক পুত্র সন্তান তিনি জন্ম দেন। সংসারের সদস্য বেড়ে যাওয়ায় চার দিক ঘিরে ধরে অভাব-অনটন। যেন কোন এক দৈত্য পরিবার টিকে গ্রাস করছিলো। দম ফেলতে পারছিলোনা তাঁর স্বামী বাবুল হক। কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাই চোরাপথে কাজের সন্ধানে ভারতে যান তার স্বামী। সেই বছরটি ছিলো ১৯৯৯ । সেই দেশের পানিপথ ও পাঞ্জাব প্রদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকের কাজ করেন বাবুল।
আড়াই বছর পর পনের হাজার টাকা নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরেন। ঐ টাকা দিয়ে শুরু করেন মুদির দোকান । কিছু দিন ভালোই চলছিলো তাদের সংসার। কিন্তু বাকি বকেয়া পড়ায় ধীরে ধীরে পুঁজি হারিয়ে যায়। পুঁজি হারিয়ে চোখে সরিষার ফুল দেখে বাবুল।
কঠোর পরিশ্রম আর সংগ্রাম করে দূর করেছে নিজেদের বেকারত্ম, বয়ে এনেছে সফলতা, এনেছে সংসারে স্বছলতা। নিজে স্বপ্ন দেখেছে, অন্যকেও ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে। আর এর সবটুকুই সম্ভব হয়েছে দৃঢ় মনোবল ও ফাতেমার আত্মবিশ্বাসে।
তবে পথ দেখিয়েছে স্থানীয় একটি এনজিও। আর ডি আর এস-বাংলাদেশ নামে এই এনজিওটি । সামান্য কিছু পুঁজি ও বাবুলের সঞ্চয়ী অভিজ্ঞতা এবং ঐ এনজিও টির ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু হয় ফাতেমার পথ চলা। চারটি মেশিন কিনে বাড়িতেই স্থাপন করেন পাপোস (পা মুছা) তৈরির কারখানা।
দেশের অনেক লোক শিল্প যখন হারাতে বসেছে, তখন নবোল্লাসে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে ঠাকুরগাঁয়ের ফাতেমার এই শিল্প। আর এটা বাস্তব করেছেন সাহসী এই নারী উদ্যোক্তা। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে অন্যান্য ভূমিকা রাখায় জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি।
২০০৪ সালে শুরু করা ক্ষুদ্র এই শিল্পটি কালের পরিক্রমায় বর্তমানে বৃহৎ আকার ধারন করেছে। ফাতেমার এখন দুটি কারখানা। চারটি মেশিন থেকে সাতচল্লিশটি মেশিন তাঁর। খুব অল্প সময়ে তার উৎপাদিত পাপসের কদর বাড়ে । দেশ ও দেশের বাইরে বিক্রি হচ্ছে তার বানানো পাপোস। বাহারি নকশা ও টেকসই হওয়ায় দিনদিন চাহিদা বাড়ছে। পুঁজির অভাবের কারণে মেশিন বাড়াতে পারছেনা ফাতেমা। ফলে চাহিদা পূরণে তিনি ব্যর্থ হচ্ছেন।
এক সময় তিনি নিজেই এই কাজ করতেন। এখন প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন শ্রমিকদের আর কারখানা তদারকি করছেন। তার স্বামী কাঁচা মাল সংগ্রহ ও বাজারজাতের কাজ করছেন। তাঁর কারখানায় শ্রমিকের কাজ করছে এলাকার দুইশ নারী ও পুরুষ। তার মধ্যে স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষাথীরাও রয়েছে। তাদের প্রত্যেকে অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিদিন তৈরি হয় কমপক্ষে তিন হাজার পাপোস। আর এই পাপস বিক্রির টাকায় চলে ওই সব খেটে খাওয়া শ্রমিকের সংসার। চলে অনেকের পড়াশোনার খরচ। দৈনিক আয় করেন ২ থেকে ৩ শ টাকা।
আপনার মতামত লিখুন :