শিরোনাম
◈ জিয়াউর রহমানের সময়ই দেশে বিভেদের রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়: ওবায়দুল কাদের  ◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসকে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য দুঃখজনক: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন

প্রকাশিত : ২৩ অক্টোবর, ২০১৮, ০৪:১৩ সকাল
আপডেট : ২৩ অক্টোবর, ২০১৮, ০৪:১৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘ভালো থাকুক সবাই, আনন্দ আসুক প্রতিটি জীবনে

ড. সেলিম জাহান : ‘সত্যবাবুদের বাড়ির প্রতিমা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে’। বেশ জোরের সঙ্গে সিদ্ধান্ত জানায় তিনটে কিশোরের একটি। ‘সত্যবাবুদের বাড়ির প্রতিমা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে’। বেশ জোরের সঙ্গে সিদ্ধান্তে জানায় তিনটে কিশোরের একটি। ‘তোকে বলেছে!’, প্রতিবাদ জানায় দ্বিতীয় কিশোরটি, ‘সবচেয়ে ভালো হয়েছে চকবাজারের ম-প’। ‘তুই প্রতিমার কি জানিস?’, রেগে যায় প্রথম কিশোরটি, ‘তোরা পূজো করিস?’
উত্তেজিত দু’কিশোর প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে আসে। তৃতীয় যে বালকটি এতক্ষণ চুপচাপ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল, সে এবার নীচু স্বরে বলে, ‘এই চুপ, চুপ! প-িত মশায় আসছেন’।

অন্য দু’টি কিশোর এ সাবধান বাণীতে সচেতন হয়ে ওঠে। ততক্ষণে একেবারে কাছে পড়েছেন। ‘নমস্কার,প-িত মশায়’ বলতে বলতে দু’মিনিট আগের ঝগড়া ভুলে গিয়ে তিন কিশোরই প-িত মশায়ের পদতলে সাটাঙ্গে প্রণিপাত। ‘বেঁচে থাকো, বাবারা। দীর্ঘজীবী হও’। বলতে বলতে তিন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তিন কিশোরেকে বুকে টেনে নেন প-িত মশায় সত্যবাবুদের বিরাট পূজোম-পের সামনে। পঞ্চান্ন বছরেরও ওপরে কোন এক বিজয়া দশমী। স্থান বরিশাল শহরের মধ্যিস্থান।

‘খুব ক্ষিদে পেয়েছে’, তিন কিশোরের একজন ঘোষণা করে প-িত মশায়ের বিদায়ের ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেইÑ কিছুক্ষণ আগের জোর তর্ক তখন ইতিহাস মাত্র। ‘বিমলদের বাড়ি সবচেয়ে কাছে’, একজন বলে ওঠে। মিনিট দশেকের মধ্যেই তিনজন বিমলদের বাড়ির রান্নাঘরের সামনে। বিমল বাবু তখন সবেমাত্র ফলারে বসেছেন। এ ত্রিমূর্তিকে দেখে তিনি মোটেই প্রীত হন নাÑবুঝতেই পারেন বন্ধুরা ভাগ বসাতে এসেছে।
কিন্তু ভীষণ প্রীত হন আশা মাসিমাÑবিমলের মা। উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার মুখ হাসি আর আনন্দে। ‘আয়, আয় বোস’, বলতে বলতে তিন পাত পাড়েন তিনজনের জন্য। ক্ষিদের চোটে ত্রিরতœ মাসীমাকে বিজয়ার প্রণাম করতে ভুলে যায়। ‘ওদের পাতে দু’টো করে নাড়– দিয়েছ কেনো? আমাকে দিয়েছো মাত্র...’, বিমল বাবু কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন। ‘ছি, এ ভাবে বলতে হয় না। ওরা অতিথি না? অতিথি নারায়ণ’, বিমলের মা ভারী নরম গলায় বলেন।

কেন, ঈদের সময়ে যখন আমাদের বাড়িতে যাস, তখন আম্মা তোকে আটটা মাংসের টুকরো দেন না? আমাকে দেন মাত্র চারটে, একটি কিশোর মোক্ষম যুক্তি উত্থাপন করে।

পেটপূজো সেরে মাসীমাকে কোনক্রমে একটি ছোট্ট প্রণাম সেরে তিন বন্ধু বাইরে এসে দাঁড়ায়। পেটটা ঠিকমতো ভরানো হয় নিÑকি করা যায় এখন। ‘চল, শুভোদের বাড়িতে গিয়ে রাবড়ি খেয়ে আসি’, একজন প্রস্তাব দেয়। এরচেয়ে ভালো কথা আর হয় নাÑভাবে অন্য দু’জনা। নীলিমা কাকিমা ভারী ভালো রাবড়ি বানান। শিব্রাম পড়ার পর থেকেই তিনজনাই রাবড়ির ভারী ভক্ত। মিনিট বিশেক পরে এই তিন হরিহর আত্মাকে দেখা যায় কলেজ পাড়ায় শুভেন্দুদের বাড়ির সামনের দরজায়।

খোলা দরজা দিয়ে তিনজনেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। আর পড়বি তো পড়, একেবারে নীলিমা কাকিমার সামনে। একপেড়ে করে পরা মোটা লাল পাড়ের গরদ পরা, কপালে লাল বড় টিপ, শাঁখা-সিঁদুরে ফর্সা কাকিমাকে প্রতিমার মতো মনে হয় তিন কিশোরের কাছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম কাকিমার, দু’হাতে দু’টো নৈবেদ্যের থালা। ঢিপ ঢিপ করে কাকিমাকে প্রণাম করে তিনজনই। ‘ওরে, থাম, থাম। থালাদুটো আগে নামিয়ে রাখি’। কাকিমা বলে ওঠেন। ‘রাবড়ী আছে?’, সময় নষ্ট করতে রাজী নয় ত্রিরতœ। ‘ও, এজন্যই আসা বাবুদের’, মুখ টিপে হাসেন নীলিমা কাকি, ‘বিজয়ার প্রণামী-ট্রনামী কিছু নয়’। ঢিপ ঢিপ করে আবার প্রণামÑরাবড়ি না ফসকে যায়। খিল খিল করে হেসে ওঠেন কাকিমা। তারপর ভারী মায়াময়কণ্ঠে বলেন, ‘আয়, দিচ্ছি’।

রাবড়ি দিয়ে পেট ভরিয়ে রাস্তায় নামতেই দেখা গেল হারানকাকা আর সিরাজ চাচা গল্প গল্প করতে এদিকেই আসছেন। ‘রাবড়ি খেতে আসছেন’, তিন কিশোরের একজন বাকি দু’জনকে জানায়। তারপর তিনজনই হাসিতে ভেঙে পড়ে। ‘কি রে, টই টই করে সারা দুপুর পাড়া বেড়াচ্ছিস কেন? যা বাড়ি যা’, সিরাজ চাচা ধমকে ওঠেন। ওঁরা পার হয়ে যেতেই তিন কিশোর ঠোঁট বাঁকায়Ñ‘হুঁ, নিজেরা পাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে! আর আমরা ঘুরতেই যতো দোষ। বড়রা ভারী হিংসুটে হয়’, দ্রুত এ সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে তিন কিশোরের এক মিনিটও লাগে না।

ঠিক তখনই দেখা যায় বাঁদিকের গলিতে বেরিয়ে আসছেন নাজমা আপা আর রতœাদি। স্কুলের শেষ বছরে পড়া দুজন গলায় গলায় বন্ধু। গুজ গুজ করে তিন বন্ধু কি যেন মতলব ফাঁদে। তারপর বান্ধবী দুজন একেবারে সামনে আসতেই দুজন কিশোর দ্রুত প্রণামের ভঙ্গিতে দু আপা আর দিদির পা জড়িয়ে বসে পড়ে। তরুণী দুজন পরম বিব্রত। ‘এই, একি শয়তানী হচ্ছে!, দাঁড়া, এমন মার খাবি না!, ছেড়ে দে লক্ষ্মী ভাই আমারÑভয় দেখানো, অনুরোধ-উপরোন্ত, কিন্তু নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু। বিজয়ার প্রণাম। দুজনকে দুটো টাকা দিয়ে দাও, ছেড়ে দেবে, তৃতীয় কিশোরটি ত্রাণকর্তার ভূমিকা নেয়। পারলে তিন জনকেই ভস্ম করে দেয় তরুণী দুজন তাদের চোখের দৃষ্টি দিয়ে। দিতেই হয় টাকাÑতিন কিশোরের উল্লাস দেখে কে? আপাতত বাড়ি যাওয়া যাক। রাতে আবার প্রতিমা বির্সজনের সময়ে দেখা হবে।

গভীর রাত। কীর্তনখোলার পাড়। প্রতিমা নৌকোয় নিয়ে মাঝনদীতে গেছে। ঢোলের বাদ্যি তুঙ্গে। নদীর পাড় ধরে শত শত মানুষ। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ঐ তিন কিশোর। সবার চোখে জলÑতিন কিশোরেরও। প্রণামের ভঙ্গিতে সবাই যুক্তকর হয়Ñকে কোন ধর্মের তা সেখানে তুচ্ছ। এক সময়ে ঝরাত করে একটা শব্দ হয়Ñপ্রতিমা বির্সজিত হয়েছে। তিন কিশোর বন্ধু জলভরা চোখে পরস্পরকে টেনে নেয় উষ্ণ আলিঙ্গনে।
পঞ্চান্ন বছর পরে আজকের বিজয়া দশমীতে ঐ তিনটে কিশোরের একজন পেছন ফিরে তাকিয়ে আছে। ঐতো ১৯৬৪র দাঙ্গার পরে অপূর্বরা চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে অতি ভোরে। ঠেলা গাড়ির মাথায় বসা অপূর্ব জামার হাতায় চোখ মুছছে। আজকের পেছন ফিরে তাকিয়ে থাকা কিশোরটি হাতের ডালটি মট করে ভেঙ্গে ফেললোÑকোন রাগে কে জানে। ঐ তো তার কবছর পরে ডেনিসরা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমালÑসংখ্যালঘু খৃস্টানদের জন্য নিরাপদ নয় এই দেশ। যে দিন ওরা চলে যায়, আজকের পেছন ফিরে তাকানো কিশোরটি শুধু একবার আকাশের দিকে তাকিয়েছিলো। কি যে কার নালিশ আর কার কাছে যে নালিশÑকে জানে। আস্তে আস্তে পেছন ফিরে তাকানো কিশোরটি সামনের দিকে মুখ ফেরায়Ñদেখা যায় তাকে পরিস্কার। এ তো আর কেউ নয়Ñএ যে আমি।

আজও বিজয়া দশমী। এ বছর দূর্গা পূজোর পরতে পরতে যেন সার্বজনীনতা টের পাচ্ছি। সামাজিক মাধ্যমের ফলে জানতে পারছি দেশে কত বেশি পূজো ম-প তৈরি হয়েছে। সেখানে পূজারীরা যেমন আছেন, তেমনি আছেন তাদের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বন্ধু-বান্ধবেরা। উৎসবে-আনন্দে তারা সবাই মিশে গেছেন। ঐ তো এক মুসলমান দোকানি দায়িত্ব নিয়েছে পাঁচ হাজার জিলিপি যোগানের। তাকে সাহায্য করছেন তার পরিবারের সদস্যেরা এবং তার দোকানের কর্মচারিরা। দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে পূজো ম-পে পূজারীবৃন্দ ও অন্যান্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। সত্যিই তোÑ‘ধর্ম যার যার, কিন্তু উৎসব সবার’।

এই ছবিগুলো অটুট থাকুক। দুর্গা পূজো সার্বজনীন, খ-িত নয়, এ উৎসব অবিভাজ্য, বিভাজিত নয়, এ কর্মকা- বৃহত্তর সংস্কৃতি, আজ সীমিত ধর্ম নয়। রাম আর রহিম আলাদা নয়, জলের সঙ্গে পানি মিলতে পারে, আল্লাহর আর ভগবান এক। ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ আমাদের এ পৃথিবীতে আর যেন গ্রাস না করে
‘আশা জাগে, ভালো লাগে’Ñবিজয়ার শুভেচ্ছা যাচ্ছে এক মানুষের কাছ থেকে আরেক মানুষের কাছে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। ‘ভালো থাকুক সবাই, আনন্দ আসুক প্রতিটি জীবনে, মঙ্গল হোক সবার’Ñসব শুভেচ্ছার ওটাই তো মূলকথা। কিন্তু তারপরেও কথা আছে বিজয়ার শুভেচ্ছারÑ‘আমরা কেউ একা নই, আমরা সবাই সবার সঙ্গে আছি, আমরা সবাই মিলে অদ্ভুত সব আঁধারকে সরিয়ে দেব’। আমাদের সবার মুক্তি ‘আলোয় আলোয় এই আকাশে’। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়