শিরোনাম
◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসকে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য দুঃখজনক: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে

প্রকাশিত : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ০৬:০০ সকাল
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ০৬:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘একদিন এসব ট্রফি আমাদের জন্য মামুলি হয়ে উঠবে’

স্পোর্টস ডেস্ক: ফাইনালের পর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে হোটেল কক্ষে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দুইটা। আরেকটি ফাইনালে শেষ বলে হারার যন্ত্রণা অধিনায়ককে ঘুমাতে দেয়নি বাকি রাতটুকু। তবে রাত্রি শেষে ভোরের আলোয় টুর্নামেন্টের প্রাপ্তিগুলো তাকে দেখাচ্ছে নতুন স্বপ্ন। দেশে ফেরার আগে দুবাইয়ের টিম হোটেলে মাশরাফি বিন মুর্তজা ফিরে তাকালেন এই টুর্নামেন্টে। আলো ফেললেন সামনের পথচলায়ও।

রাত পেরিয়ে সকাল, হারটা কতটুকু হজম হলো?

মাশরাফি বিন মুর্তজা: যে কোনো ম্যাচ হারলেই খারাপ লাগে। এ রকম একটা ফাইনাল হারলে আরও বেশি খারাপ লাগা স্বাভাবিক। কতটা কষ্ট করে, কতকিছু সামলে আমরা শিরোপার এত কাছে যেতে পেরেছিলাম, কেবল আমরাই জানি। কষ্ট লাগছে।

তবে এটাও সময়ে সয়ে যাবে। আমি মনে করি এই টুর্নামেন্ট থেকে আমাদের অনেক অনেক প্রাপ্তি আছে। পরাজয়েও পজিটিভ কিছু খুঁজছি, এসব হয়তো অনেকের কাছে ক্লিশে লাগতে পারে। অধিনায়ক হিসেবে আমি জানি কতটা পেয়েছি। সবচেয়ে বড় দুটি প্রাপ্তি, ৫ নম্বরে মিঠুনকে পাওয়া আর ওপেনিংয়ে লিটনের ফাইনালের পারফরম্যান্স।

আমি বলছি না যে এখনই আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, আমরা নিশ্চিত। কিন্তু ওদের পারফরম্যান্সে অন্তত এখন থেকে দল ভরসা করতে পারবে ওদের ওপর। এরচেয়েও বড় কথা, ওরা নিজেদের সামর্থ্যে আস্থা পাবে। এটা খুব জরুরি ছিল।

মুস্তাফিজ, মিরাজের পারফরম্যান্সও তো দারুণ ছিল।

মাশরাফি: এটাও প্রাপ্তি বলতে পারেন। মুস্তাফিজ প্রায় আগের চেহারায় ফিরে আসছে। গতি ফিরে আসছে ওর। মিরাজ গত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকেই অসাধারণ বোলিং করছে। ফাইনালটা দুর্ভাগ্যজনক ভাবে খারাপ গেছে ওর।

আরেকটা বড় প্রাপ্তি আমি বলব, সাকিব-তামিকে ছাড়া খেলেও যে কিছু করা যায়, এই বিশ্বাস পাওয়া। কখনও আমিও নাও থাকতে পারি, মুশফিক বা যে কেউ না থাকতে পারে। কে থাকল, কে থাকল না, এই ভাবনায় কাতর হওয়ার দিন শেষ।

তবে সত্যি বলতে, এই সবকিছু প্রাপ্তি হিসেবে বিবেচনা করা যাবে যখন সামনে এসব কাজে লাগবে। লিটন-মিঠুন ফর্ম ধরে রাখবে, যে কাউকে ছাড়া লড়াইয়ের বিশ্বাসটা টিকে থাকবে, তখনই এই টুর্নামেন্টের পাওয়াগুলো সার্থক হবে।

গত ৯ বছরে ৬টি ফাইনালে হার, ৫টিতে আপনি ছিলেন। দল কি ফাইনালের ‘মেন্টাল ব্লক’ থেকে বের হতে পারছে না?

মাশরাফি: হতে পারে। কালকে যখন খেলা শুরু হলো, তখন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু ওপেনিং জুটি সেঞ্চুরি করে ফেলল, তখন একটা পর্যায়ে মন দুরুদুরু করছিল যে এখান থেকে যেন ভেঙে না পড়ে, বাজে কিছু না হয়। সেটাই হয়ে গেল পরে। খারাপ হতে পারে, এই ভয় থেকেই হয়ত খারাপ হয়ে গেছে!

যতোই বলি ফাইনালটা আর দশটা ম্যাচের মতো খেলব, তবু সবাই তো একভাবে ভাবতে নাও পারে। সবাই জানে, একটাই ম্যাচ! কোনো একদিন যদি একটি ফাইনাল জিতে যাই, তখন আমি মনে করি জিততেই থাকব। সে ফাইনাল কবে জিতব, সেটা জানি না।

ক্রিকেট ভীষণরকম মনস্তাত্ত্বিক খেলা। ফাইনালে সব দলেরই বাড়তি চাপ থাকে। কিন্তু যারা জিতেছে আগে, তারা জানে কিভাবে জিততে হয়। আমরা হয়তো একবার জিতলে বুঝতে পারব।

শুধুই কি মানসিক, নাকি স্কিলেরও ঘাটতি আছে?

মাশরাফি: আমার মনে হয় না আমাদের ছেলেদের স্কিলের ঘাটতি খুব বেশি আছে। অবশ্যই উন্নতির শেষ নেই। তবে খুব পিছিয়ে নেই আমরা। সমস্যা মানসিকতায়।

লিটনের কথাই ধরুণ। ফাইনালের আগে একদিনের মধ্যে তো নিজের স্কিলে জাদু করে কিছু করে ফেলেনি। ফাইনালে যা খেলল, সেটাই ওর স্কিল। কিন্তু আগের ম্যাচগুলোয় মানসিকভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি।

মিরাজকে দেখুন। ওপেন করেছে। বুমরাহ-ভুবনেশ্বরকে খেলতে বড় বড় ব্যাটসম্যানদেরও সমস্যা হয়। মিরাজ কত সুন্দর সামলে নিল। স্কিলটা আছে। কিন্তু মূল ব্যাপার হলো, ফাইনালে ওরা দুজন মানসিকভাবে শক্ত ছিল। যেটা আগে হয়তো ছিল না।

আর স্কিলের ঘাটতি থাকলে সেটা কাজ করে উন্নতি করা যায়। মানসিক ব্যাপারগুলো তো এমন নয় যে প্র্যাকটিস করে, নেটে কাজ করে ঠিক করে ফেললাম!

মানসিক সামর্থ্য বাড়ানোর উপায় কি তাহলে? মনোবিদের পরামর্শ কাজে লাগে?

মাশরাফি: মনোবিদ কাজে লাগতে পারে। সারা বিশ্বে তো এটাই চলে দেখি। তবে ব্যাপারটা যার যার ব্যক্তিগত। ওই ক্রিকেটারকে বুঝতে হবে আমার কোথায় কোন পরিস্থিতিতে কোন সমস্যা। তার পর সেটা নিয়ে হয়ত মনোবিদের সঙ্গে কাজ করতে পারে।

সমস্যা হলো, আমাদের দেশের সংস্কৃতি তো ওরকম নয়! আপনার ঘরে বাচ্চার কোনো সমস্যা হলো, কেউ যদি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর কথা বলে, আপনি হয়তো রেগে বলবেন যে ‘আমার ছেলে কি পাগল নাকি?’ আমাদের সংস্কৃতিই এমন।

কিন্তু আমার কাছে মনে হয় যদি একজন ক্রিকেটার মনে করে আমার এখানে সমস্যা হচ্ছে, মনোবিদের সঙ্গে কথা বলি, তাহলে উপকার ছাড়া আর কিছু হবে না। কোন পরিস্থিতিতে কে কেমন বোধ করে, একমাত্র সে নিজেই জানে। কালকে ধরুন একজন স্পিনার যদি ভালো করতো, ১০ রানও কম দিত, তাহলে ম্যাচটা আমরা জিততাম। অপু-মিরাজ আগে খুবই ভালো বল করেছে। কালকে হচ্ছিল না। আমি, মুশি, রিয়াদ, আমরা সবাই ওদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কিন্তু ওদের ভেতর ঠিক কি চলছিল বল করার সময়, ওরাই জানে। এখন এটা সে মনোবিদের সঙ্গে কথা বলবে নাকি, ব্যক্তিগত কোচের সঙ্গে বা কার সঙ্গে, এটা তার ব্যাপার। আগে এটা নিজেকে মানতে হবে যে এই জায়গায় আমার মানসিকভাবে সমস্যা হচ্ছে।

লিটনের কথা বলছিলেন, ওপেনিং সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করছেন?

মাশরাফি: সমাধান হবেই, সেটা কেউ বলতে পারে না। সময়ে জানা যাবে। তবে একটি ইনিংস একজন ক্রিকেটারের জীবন বদলে যেতে পারে। শচিন টেন্ডুলকার ছিলেন মিডল অর্ডার, প্রথমবার ওপেন করে ঝড় তুললেন, তার ক্যারিয়ার শুধু নয়, ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাস বদলে যাওয়ার শুরু হলো।

টেন্ডুলকার ইনজুরিতে, শেবাগ এসে ৭০ বলে সেঞ্চুরি করল। আমি তুলনা করছি না। স্রেফ বলছি যে একটি ইনিংসে ক্যারিয়ার পাল্টে যাওয়ার উদাহরণ ক্রিকেটে অসংখ্য আছে। অনেকেরই বুঝতে অনেক সময় লাগে যে এই পর্যায়ের ক্রিকেটে আমার সামর্থ্য কতটা। একটি ইনিংস হয়তো তাকে বিশ্বাস জোগায়। পরের বার যখন লিটন বা মিঠুন ব্যাট করতে নামবে, আমি আশা করব, নিজেকে নিয়ে ওদের সংশয় থাকবে না। আউট হতেই পারে, খারাপ করতে পারে। কিন্তু নিজের সামর্থ্যে যেন বিশ্বাস থাকে। সেটি থাকলে সফল হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।

টুর্নামেন্ট জুড়ে বা শুরুর আগে লিটনের সঙ্গে অনেক কথা বলেছেন। ফাইনালের আগে কি বলেছিলেন?

মাশরাফি: খুব নরম্যাল কথা যে, ‘নিজের খেলা খেলবি, আর কিছু ভাবার দরকার নেই।’ ব্যাটিংয়ে নেমেছে, ৩ ওভার পর্যন্ত একটু কেমন যেন ছিল। কাট খেলতে চাচ্ছে, হচ্ছে না। আমি খবর পাঠালাম যে, ‘তুই যা ইচ্ছা কর। কিন্তু দ্বিধা নিয়ে করবি না। যেটাই খেলবি, মনে করবি ঠিক করছি। সেটা করতে গিয়ে আউট হলে, আমার আপত্তি নেই। আমতা আমতা করে ভাববি না।’ খোলা মন নিয়ে খেললে কেমন খেলে, সেটাই দেখিয়েছে।

লিটন ফিফটি করার পর আপনি ড্রেসিং রুমের বাইরে এসে ইশারা করলেন ইনিংস বড় করতে, বুকে জার্সিতে আঁকা প্রতীকে ইঙ্গিত করলেন দলের জন্য খেলতে, আপনার কি ভয় ছিল যে লিটন উইকেট বিলিয়ে আসতে পারে?

মাশরাফি: অনেক সময় দেখা যায় যে ব্যাড-প্যাচে থাকা কোনো ব্যাটসম্যান ফিফটি করার পর একটু রিল্যাক্স হয়ে যায়। ভেতরে হয়ত স্বস্তির অনুভূতি কাজ করে। আমাদের ব্যাটসম্যানরা অনেক সময় ভুলেও যায় অনেক কিছু। আমি বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে দায়িত্ব শেষ নয়। সবদিন এ রকম সুযোগ আসে না। কাজে লাগাও। আর বোঝাতে চেয়েছিলাম, দলের জন্য খেল, বুক চিতিয়ে খেল। যা হবার হবে। কোনো পর্যায়ে যেন না মনে হয় যে পারব না।

আপনি এটা দেখানোর এক বল পরই বাজে শট খেলে ক্যাচ দিয়েছিল...

মাশরাফি: খুব আপসেট হয়েছিলাম। আমার কথা শোনেনি বলে নয়, নিজের একটা সুযোগ হেলায় হারাতে যাচ্ছিল বলে। ক্রিকেট বুদ্ধিমত্তার খেলা। সেটার ছাপ রাখতে হয়। এত দারুণ খেলার দিনে প্রতিপক্ষকে উইকেট দিয়ে আসার মানে নেই।

দলের দিক থেকেও যদি ভাবে, ওকে তখন উইকেটে দরকার। কারণ সুইপ ভালো খেলেছে। ভারতীয় স্পিনাররা বলই ফেলতে পারছিল না ওর সুইপের সামনে। ও কেন ঝুঁকি নিয়ে উড়িয়ে মারবে? ঝুঁকি নিতে হলে মিরাজ নেবে। কারণ ওর কাছ থেকে যা চাওয়া ছিল, পাওয়া হয়ে গিয়েছিল। তো এগুলো ভাবতে হবে। ভাগ্য ভালো, কালকে বেঁচে গেছে। সব দিন বাঁচবে না।

জীবন পাওয়ার পর যেভাবে ব্যাটিং করল, সেটা আপনাকে কতটা মুগ্ধ করেছে?

মাশরাফি: অবিশ্বাস্য। ওর ক্লাসটা দেখিয়েছে। একদমই ঝুঁকি না নিয়েও অনায়াসে রান করেছে। টেনে নিয়েছে। পরে আমাদের সিনিয়রদের যেটা করার কথা ছিল।

আশা করি, লিটন এখন নিজেকে বুঝতে পারবে। কিন্তু যদি বুঝতে না পারে, তাহলে এই ইনিংসের মূল্য ভবিষ্যতে থাকবে না। অনেকেই এরকম ইনিংস খেলেছে, পরে আর শিক্ষাটা নিতে পারেনি। আশা করি লিটন বুঝতে পারবে যে, উইকেটে থাকলে, বল সিলেকশন ভালো হলে, সে কতটা কি করতে পারে। সেটা যদি পারে, তাহলে শুধু নিজের না, বাংলাদেশ ক্রিকেটেরও অনেক বড় পাওয়া হবে। বাংলাদেশকে অনেক কিছু পাবে ওর ব্যাট থেকে।

ফাইনালের আগের দিন প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন, ফাইনালে চমক দিতে পারেন। মিরাজকে ওপেন করানোর ভাবনা কখন, কিভাবে এসেছিল মাথায়?

মাশরাফি: প্রেস কনফারেন্সে কিছু ভেবে বলিনি। স্রেফ বোঝাতে চেয়েছিলাম, যে কোনো কিছুই হতে পারে। ভাবনা এসেছে ফাইনালের আগের দিন রাতে খাওয়ার সময়। কি করব, কি করা উচিত, সিরিজ চলার সময় এসব আমার মাথায় সবসময়ই ঘুরতে থাকে। একটা ম্যাচের পর থেকেই আরেক ম্যাচের ভাবনা শুরু হয়ে যায় অটোমেটিক। তো অনেক ভাবছিলাম। ডিনারের সময় হুট করেই মাথায় এলো মিরাজের কথা।

মিরাজও তখন খাচ্ছিল। গিয়ে সোজা বললাম, ‘তুই কালকে ওপেন করবি।’ ও দেখি চমকে গেছে, আমতা আমতা করছে। বললাম, ‘তোর কাছে আমি রান চাই না। ভুবনেশ্বর-বুমরাহর ৮ ওভার ঠেকাবি। টেস্ট ম্যাচের মতো ব্যাটিং করবি। উইকেট হারাতে চাই না আমি শুরুতে।’

মিরাজ বলল, ‘ভাই, করব ওপেন।’ আমি বললাম, ‘শুরুতে বলার পর যেরকম করলি, মনে হচ্ছে তোর ভেতর ডাউট আছে?’ ও বলল, ‘না ভাই, হুট করে শুনে এরকম করেছি। জীবনে তো করি নাই। তবে পারব।’ আমি এরপর বললাম, ‘আমিও জানি তুই পারবি। শুধু দেখলাম তুই বিশ্বাস করিস কিনা। গিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করার দরকার নাই, শুধু পড়ে থাকবি। ৮ ওভার তুই আমার জন্য খেলবি। কিছু করবি না। এর পর যা ইচ্ছা করিস।’ যা চেয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছে ও।

কালকে উল্টো হয়ে গেল, অন্যরা পারল, কিন্তু সিনিয়ররা পারল না। মুশফিক যেভাবে ব্যাট করেছে আগে, মাহমুদউল্লাহ যেভাবে উদ্ধার করেছে দলকে, ওদের দিকে আঙুল তোলা কঠিন। কিন্তু খারাপ সময়টা বড় ম্যাচেই এলো!

মাশরাফি: হতাশার তো বটেই। একটু দায়িত্ব নেওয়া দরকার ছিল কালকে। আমরা জানতাম, এই উইকেটে ২৬০ রান হলে ভারতের সঙ্গে তুমুল লড়াই হবে। ২৮০ হলে জয়ের মতো স্কোর। টপ অর্ডার যেখানে নিয়ে গেছে, এরপর আর খুব বেশি কিছু দরকার ছিল না। এক-দুই করে নিলেও ২৭০-২৮০ হয়ে যায়। তিনশও হতে পারত।

ওরা দুজনও অবশ্যই হতাশ। বড় ম্যাচে কে না পারফর্ম করতে চায়। কিন্তু ওই যে মনস্তাত্ত্বিক কথা বলছিলাম, ওরা নার্ভাস হয়েছিল কিনা, কিংবা কি ভাবছিল ওই মুহূর্তে, কেবল ওরাই জানে। কুলদীপ-চেহেল কেউ যখন পারছে না, কেদার যাদব এসে উইকেট নিয়ে গেল।

কেদার যাদব গত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি-ফাইনালেও মাঝপথে তামিম ও মুশফিকের উইকেট নিয়েছিল। নিয়মিতই ব্রেক থ্রু দেয়। তাকে খেলা নিয়ে পরিকল্পনা ছিল না?

মাশরাফি: ছিল তো বটেই। সবই বলা হয়েছে। কিন্তু মাঠে বাস্তবায়ন ঠিকভাবে হয়নি। ভারত দেখুন, সবাই ২৫-৩০ রান করেই জিতিয়েছে দলকে। আমাদেরও আর কেউ ২৫-৩০ করলে হয়ে যেত ২৬০-২৭০। হয়নি। এটাই ক্রিকেট। সব দিন হয় না।

শেষ ওভারে সৌম্যকে শুরুতে দিলেন কোন ভাবনা থেকে? সেটি আবার বদলালেন কেন?

মাশরাফি: সৌম্যকে শুরুতে দিয়েছিলাম স্ট্রাইকে কুলদীপকে দেখে। ভেবেছিলাম, স্লোয়ার করলে, মারতে গেলে আউট হবে। পরে মনে হলো যে, ৬ রান দরকার তো, পেস বল মারতে যাবে না। উইকেট না নিলে ৬ রান আটকানো যাবে না। এজন্যই স্পিন আনলাম যে মারতে গিয়ে আউট হতে পারে।

রিয়াদকে বললাম যে, ‘তোর কনফিডেন্স কতটা?’ রিয়াদ বলে, ‘বোলিং করব?’ বললাম, ‘তোর মন কি বলে?’, ও বললো, ‘ভাই দেন, চেষ্টা করব।’

রিয়াদ অবিশ্বাস্য বোলিং করেছে। প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও খুব আত্মবিশ্বাসী বোলিং করেছে। পঞ্চম বলটা কুলদীপের ব্যাটের কানায় লেগে ওর পায়ে লেগে দূরে গেল। ওটা যদি রান না হতো, আমার মনে হয় না শেষ বলে ২ নিতে পারত। রিয়াদ অসাধারণ করেছে।

ভাগ্য খারাপও কি বলা যায়? ছয়টি ফাইনালে হারের যন্ত্রণা, হয়তো বড় কোনো আসরে অপেক্ষা করছে বড় আনন্দ!

মাশরাফি: আমি তো বরাবরই ভাগ্যে বিশ্বাস করি। ভাগ্যে ছিল না, এটা তো বলতেই হয়। আর হ্যাঁ, বাংলাদেশ ক্রিকেট তো এখানেই থেমে থাকবে না। একদিন অনেক কিছুই জিতব আমরা। সেদিন আমরা থাকি আর না থাকি। সবাই তো সবকিছু পায় না। এক প্রজন্ম কষ্ট করবে, আরেক প্রজন্ম ফল পাবে, এ রকম হতেই পারে। আমি নিশ্চিত, একদিন এসব ট্রফি আমাদের কাছে মামুলি হয়ে উঠবে। অনেক বড় বড় ট্রফি জিতব আমরা।

তবে আগেও যেটা বললাম, আমাদের মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। দেশের ক্রিকেটের উন্নতি করতে হলে, শুধু জাতীয় দল নয়, অনূর্ধ্ব-১৩, ১৫, ১৭ থেকেই মেন্টালিটি নিয়ে কাজ করতে হবে। বোর্ডের দিক থেকে হতে পারে, অভিভাবক বা ব্যক্তিগতভাবে হতে পারে। তবে সেটা লাগবেই।

টুর্নামেন্ট জুড়ে অনেকবার বলেছেন যে খুব চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে দলের জন্য। টুর্নামেন্ট শেষে পেছন ফিরে তাকালে, কতটা কঠিন ছিল?

মাশরাফি: আমার ১৭ বছরের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন টুর্নামেন্ট। প্রথমত আবহাওয়া। আক্ষরিক অর্থেই হাঁসফাঁস করতে করতে আমরা খেলেছি। সঙ্গে একের পর এক ক্রিকেটারকে নিয়ে চিন্তা। একেক দিন মাঠ থেকে এসে শকিং নিউজ পেয়েছি। প্রথম ম্যাচের পর তামিম নেই। সাকিব তো চোট নিয়েই খেলছে। পরের ম্যাচের আগে মুশফিকের পাঁজরের অবস্থা খারাপ। বিশ্রাম দিলাম।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে, মুস্তাফিজ বলল বল করতে পারবে না। পরের ম্যাচে সাকিব নেই। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে এসব হলে একরকম, টুর্নামেন্ট চলার সময় প্রতিটা মাচের আগে এসব হওয়া মানে বড় ধাক্কা। পরিকল্পনা বদলাও, মানসিকতা বদলাও। বলে ফেললাম, ‘বদলাও’, কিন্তু করা তো এত সহজ নয়! ধাক্কা সামলাব না প্ল্যান করব, এই নিয়ে মাথা খারাপ অবস্থা। ক্র্যাম্প বা ছোটখাট সমস্যা অনেকের আছেই। নিজের শরীর নিয়ে তো ভাবার সুযোগ নেই।

আমার জন্য সব সামলানো ভীষণ কঠিন ছিল। এতটা কঠিন সময় আগে আসেনি। তবে ছেলেদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, আমাকে সহায়তা করেছে। যা বলেছি, করেছে। যতটুকু পেরেছি, ওদের জন্যই সম্ভব হয়েছে। সাকিব-তামিমের না থাকাটা আমাদেরকে হয়ত আরও জেদি করেছে যে পারতেই হবে।

আপনার নেতৃত্ব নিয়ে নতুন করে বলার আছে সামান্যই। তবে শেষ দুটি ম্যাচ মাঠের অধিনায়কত্ব ছিল যেন নেতৃত্বের মাস্টারক্লাস। বোলিং-ফিল্ডিং পরিবর্তন, সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু ছিল প্রায় নিখুঁত।

মাশরাফি: আমি ঝুঁকি নিয়েছি অনেক। জুয়া খেলেছি। অনেক জায়গাতেই নিয়েছি। হয়তো মাঠের বাইরে থেকে আপনারা যতটা দেখেছেন, তার চেয়েও বেশি। কেবল আমিই সেটা বলতে পারব। সেগুলো কাজে লেগে গেছে।

জুয়াগুলোর পেছনে ক্রিকেটীয় যুক্তিও নিশ্চয়ই ছিল অনেক?

মাশরাফি: অবশ্যই থাকে। তবে আমার যুক্তিতে আপনি একমত নাও হতে পারেন। লোকে মানতে নাও পারে। কিন্তু মাঠে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমি তো নিজের মন আর মাথাকেই শুনব। আরেকজন কি বলল কিংবা করার পর কি হবে, এটা নিয়ে সংশয়ে থাকি না। সিদ্ধান্ত কাজে লাগতে পারে, নাও পারে। কাজে লাগলে লোকে বলবে ঠিক সিদ্ধান্ত, না লাগলে সমালোচনা হবে। কিন্তু আমি নিজে ঠিক-ভুলের মাঝখানে থাকতে চাই না। নিজের কাছে পরিষ্কার থেকে সিদ্ধান্ত নেই। সবসময়ই বিশ্বাস করি, ‘যদি মরো তো নিজের বুদ্ধিতে মরো, অন্যের বুদ্ধিতে নয়।’ লোকে যত যাই বলুক, আমি তৃপ্ত থাকব যে নিজের মনের কথা শুনেছি। অন্যকে ভেবে আক্ষেপ করতে চাই না।

ফাইনালের আগের দিন বলেছেন যে ট্রফি দিয়ে নিজেকে বিচার করেন না। অবশ্যই ট্রফি পাওয়া-না পাওয়ার গণ্ডিতে আপনাকে আটকে রাখা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ একটা ট্রফি জিতবে, আপনি উঁচিয়ে ধরবেন, এই স্বপ্ন নেই?

মাশরাফি: স্বপ্ন তো মানুষের কত রকমের থাকেই। চাওয়া থাকে, ইচ্ছে থাকে। সেটার তীব্রতা কত, বা ইচ্ছেটাকে কতটা প্রাধান্য আপনি দিচ্ছেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। আমি স্রেফ ক্রিকেট খেলতে চাই, দলকে জিততে দেখতে চাই। আর কোনো ইচ্ছেই আমার এমন নেই যে ওটা আমার লাগবেই।

ছেলেবেলা থেকেই আমি এমন। যেমন, ঈদ আসত, আমি জীবনেও কাপড়-চোপড় চাইনি কারও কাছে। ছোটদের চাওয়া থাকে না? আমার ছিল না। ঈদের আগের রাতেও না। আমার ধরনই এরকম।

আগেও বলেছি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য একটি ট্রফি দরকার। সেটি আমি উঁচিয়ে ধরলাম না কে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

একটু আগে বলছিলেন একদিন দল অনেক বড় বড় ট্রফি জিতবে। তখন কি আফসোস হতে পারে যে ‘আমি যদি থাকতাম!’

মাশরাফি: একটুও নয়। আগেই তো বলেছি, সব প্রজন্ম সবকিছু পায় না। একটা ট্রফি হয়তো আনন্দ দেবে। কিন্তু কিছুদিন পর ভুলেও যাবেন। চাওয়ার তীব্রতা যখন বেশি থাকে, তখন হাহাকার থাকে। পাওয়ার পর সেটার আবেদন হারাতে থাকে। এখন মনে হতে পারে, ট্রফির জন্য জীবন দিতে পারি। পাওয়ার পর মনে হবে, ‘না, জীবন দেওয়া সম্ভব নয়।’

আমি অনেক আগে থেকেই চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার নিয়ে মানসিকভাবে অনেক শক্ত। যে অবস্থা পেরিয়ে এসেছি, আমি আবার মাঠে নামতে পাব কিনা, সেটাও জানতাম না অনেক সময়। আমার শরীরের অবস্থা চিন্তা করলে, নিজেও জানি না কিভাবে খেলছি এখনও, কোনো ব্যাখ্যা নেই। আমি এখনও খেলে যাচ্ছি, বাংলাদেশের অধিনায়ক, এটা আমার কাছে শুধু বিস্ময়করই নয়, এর চেয়েও বেশি কিছু।

আমি আমার অতীত ভুলে যাইনি। এখনও খেলছি, এটার চেয়ে বড় পাওয়া আর নেই। ট্রফি একটা নগন্য ব্যাপার। হ্যাঁ, আবারও বলছি, দেশের ক্রিকেটের জন্য ট্রফি দরকার। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য দরকার। কালকে আমরা যদি জিতে যেতাম, বিশ্বকাপ বা অন্য কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে আমরা নামার সময় জানতাম যে আমরা ফাইনাল জিততে পারি। অস্ট্রেলিয়া দেখবেন, সেমিফাইনাল-ফাইনালে কাউকে পাত্তা দেয় না। ওরা জানে এসব ম্যাচ কিভাবে জিততে হয়। আমাদেরও সেটা জানা দরকার। সেদিক থেকে ট্রফি দরকার।

ভক্ত-সমর্থকদের অনেকেই বলছে, ‘মাশরাফিই আমাদের ট্রফি’ কিংবা ‘বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় পাওয়া।’ আপনি নিজে কিভাবে দেখেন?

মাশরাফি: কোনোভাবেই দেখি না। এসব ভাবিই না। আসলে আমরা আবেগপ্রবণ জাতি, অল্পতে খুশি হই, অল্পতেই ভেঙে পড়ি। জীবনের অনেক অধ্যায় দেখা হয়েছে আমার। যারা এ রকম বলছেন, তাদের প্রতি আমার সম্মান আছে। যাদের কাছে আমি কিছুই না, তাদের মতামতকেও সম্মান করি।

আমি মনে করি, আমি স্রেফ নিজের দায়িত্ব পালন করে চলেছি। দেশের প্রতিটি মানুষ নিজস্ব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছে। আমি খেলছি, আপনি লিখছেন, ডাক্তার চিকিৎসা করছে, সবাই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। আমি বুকে ‘বাংলাদেশ’ লেখা নিয়ে খেলতে নামছি, গোটা বিশ্ব দেখেছে, হয়তো এজন্য আমার দায়িত্ব বেশি। কিন্তু এই যে প্রবাসী শ্রমিক ভাইয়েরা, এত কষ্ট করে দেশের জন্য অর্থ ও সম্মান বয়ে আনছে, তার গুরুত্ব আমার চেয়ে অনেক বেশি। দেশকে সে প্রতিনিধিত্ব করছে আরও উজ্জ্বলভাবে।

আমি আমার সবটা দিয়ে দায়িত্ব পালন করছি, এটাই আমার বড় তৃপ্তি। আর কিছু ভাবি না। সূত্র: বিডিনিউজ২৪

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়