ডেস্ক রিপোর্ট : সবুজ পাহাড়ে ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকৃতি যেনো তার ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম এই বিদ্যাপীঠকে। হরেক রকম পাখির কলকাকলি, সবুজ পাহাড়ের লুকিয়ে থাকা হরিণ, আর অনেক প্রাণির জীবন্ত জাদুঘর যেন এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ঝর্ণাধারা, উদ্ভিদ উদ্যান, রহস্যময় চালন্দা গিরিপথ যেন এর সৌন্দর্য্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক গুণ।
কিন্তু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাসের যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ময়লা-আবর্জনার স্তুপ এর মনোরম রূপটা যেন অনেকটাই ম্লান করে দিচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি স্থানে চোখে পড়বে ময়লা আবর্জনা স্তুপ। প্রশাসনের তদারকি ও পর্যাপ্ত ডাস্টবিনের অভাবে ক্যাম্পাসের আশেপাশের বসতবাড়ির ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে যেখানে-সেখানে।
ফলে দুর্গন্ধসহ মশা-মাছির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। চর্মরোগ, পানিবাহিত রোগ ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিনে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, ক্যাম্পাসের রেল স্টেশন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, বিভিন্ন আবাসিক হল, হলগুলোর ক্যান্টিন, বিভিন্ন অনুষদ, অনুষদগুলোর ঝুপড়ি ও প্রশাসনিক ভবনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ জায়গায়ই নেই পরিকল্পিত ডাস্টবিন। ফলে যার যেখানে ইচ্ছে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন। এমনকি রাস্তার আশেপাশে ফেলা হচ্ছে নানা ধরনের বর্জ্য। এতে রাস্তার আশপাশও অপরিছন্ন থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশনের আশেপাশে আবর্জনা থাকায় স্টেশনে অবস্থানকালে ও ট্রেনে উঠার সময় শিক্ষার্থীদের চরম অস্বস্তিতে পড়তে হয়।
আবাসিক হলের ময়লা ফেলা হয় হলগুলোর পেছনে। এসব ময়লা আবর্জনা থেকে আসা দুর্গন্ধে রুমে থাকা দায় হয়ে পড়েছে আবাসিক শিক্ষার্থীদের।
কযেকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আবর্জনা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা বা ডাস্টবিন খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে বাধ্য হয়েই যেখানে সেখানে ময়লা ফেলতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পর্যাপ্ত ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করে দিলে এসব সমস্যার সমাধান হতো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দোকানপাট ও ঝুপড়িগুলোতেও নেই ডাস্টবিনের ব্যবস্থা। ফলে দোকানিরা দোকানের পিছনে বা ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে ময়লা ফেলছেন।
বেশ কয়েকজন দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ময়লা ফেলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা করে দেয়নি। তাহলে আমরা কোথায় ময়লা ফেলব?
বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ঝুপড়িতে একটা ডাস্টবিন থাকলেও দোকানদাররা সেখানে ময়লা ফেলেন না। তাদের দাবি, সেই ডাস্টবিন ময়লায় ভরে যাবার পরও সেগুলো সরানো হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই তারা দোকানের পিছনে ময়লা ফেলেন।
একই অবস্থা ক্যাম্পাসের প্রায় সব কয়েকটি ডাস্টবিনের। অব্যবস্থাপনার কারণে সেগুলো অনেকটা অব্যবহৃত ভাবে পড়ে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, প্রশাসনিক ভবন ও মেরিন সায়েন্সে অনুষদের ঝুপড়ির ময়লাগুলো পাশের সরু নালাতে ফেলা হয়।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির একজন কর্মচারী বলেন, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর ডাস্টবিনের অভাবে ময়লা আবর্জনা লাইব্রেরির কাছের সরু নালার পাশে ফেলা হয়।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২০-২৫টি আবাসিক কলোনির অবস্থা আরো বেশি খারাপ। কলোনির মানুষ তাদের ব্যবহৃত বর্জ্য বাড়ির পাশেই ফেলেন। এতে করে কলোনি যেমন নোংরা হচ্ছে, তেমনি দূষিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ।
এ ব্যাপারে চবি বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. খালেদ মিসবাহুজ্জামন জানান, ক্যাম্পাসের বর্জ্য নিয়ে ২০১১ সালে একটি গবেষণা করা হয়েছিল। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যাম্পাসে মাথাপিছু প্রতিদিন গড়ে প্রায় ০.১৭ কেজি করে মোট ১৫০৯ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব বর্জ্যের ৪১৬.২০ কেজি (২৮ শতাংশ) পুনরায় ব্যবহারযোগ্য হলেও ১০৯২.৭৯ কেজি (৭২ শতাংশ) পুনরায় ব্যবহারের অযোগ্য। এ বর্জ্য অনেকটা অংশ দখল করে রেখেছে পলিব্যাগ ও প্লাস্টিক সামগ্রী, যা মাটির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
তিনি আরও বলেন, এসব বিষয় সামাধানে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে পরামর্শ দিয়েছিলাম। প্রশাসন কেন্দ্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিলে এসব সমস্যা সমাধান সম্ভব। পরিকল্পিতভাবে ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের চিফ মেডিকেল অফিসার ডাঃ মোহাম্মদ আবু তৈয়ব বলেন, ক্যাম্পাসে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলার ফলে দুর্গন্ধসহ মশা-মাছির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, শ্বাসকষ্ট সংক্রামক, চর্মরোগ, পানিবাহিত রোগ ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া এসব জায়গায় পানি জমে থাকায় এডিস মশা জন্ম নিয়ে ডেঙ্গু হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
এ ব্যাপারে চবি বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. মো. দানেশ মিয়া বলেন, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে সবচেয়ে বেশি মাটি দূষণ হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্নভাবে এসব বর্জ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের ক্ষতিসহ পরিবেশ দূষণ এবং উদ্ভিদের ক্ষতি সাধন করছে।
তিনি বলেন, আমরা একাধিকবার এ বিষয়ে প্রশাসনের সাথে কথা বলেছি। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো কার্যক্রম তেমন চোখে পড়েনি। প্রশাসন উদ্যোগ নিলে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো। পাশাপাশি আমাদের সকলকে সচেতনও হতে হবে।
উপাচার্য যা বললেন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমি ভিসি হওয়ার পর গত বছর বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ২০টি ডাস্টবিন নির্মাণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। আমার আগে আর কেউ কি এমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছিল?’
তিনি আরো বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে অর্বজনা ফেলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের পাশে বড় গর্ত করা হয়েছে। ডাস্টবিনগুলো থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করতে ভ্যান তৈরী করা হচ্ছে। দ্রুত এসব বিষয়ে আরোও পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সূত্র : পরিবর্তন