শিরোনাম
◈ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী ◈ দাম বেড়েছে আলু, ডিম, আদা ও রসুনের, কমেছে মুরগির  ◈ ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন শেষ করতে চায় পেট্রোবাংলা ◈ ভিত্তিহীন মামলায় বিরোধী নেতাকর্মীদের নাজেহাল করা হচ্ছে: মির্জা ফখরুল ◈ বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী ◈ অপরাধের কারণেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের  বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী  ◈ অ্যাননটেক্সকে জনতা ব্যাংকের সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিলের নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি  ◈ ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ ইরানে ইসরায়েলের হামলার খবরে বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক

প্রকাশিত : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১১:২৮ দুপুর
আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১১:২৮ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সবই শেষ পদ্মায়!

ডেস্ক রিপোর্ট: শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় সর্বনাশা পদ্মা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। অনবরত ভাঙছে দুকূল। ভাঙনে একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের সাজানো-গোছানো ঘর-বাড়ি-ফসলি জমিসহ তাবৎ কিছু। তিল তিল করে গড়ে তোলা সহায়-সম্পদ বেপরোয়াভাবে গিলে খাচ্ছে নদী। ভাঙন প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় অসহায় মানুষের দুর্দশা বেড়েই চলেছে। যদিও গতকাল ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শনের পর পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের (ভারপ্রাপ্ত) সচিব কবির বিন আনোয়ার  সেখানে বাঁধ নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে শুধু পদ্মা নয়, বিভিন্ন নদীর ভাঙনে আশ্রয়হীন হয়ে চলেছেন মানুষ। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো বিবরণ—

শরীয়তপুর : শরীয়তপুরের নড়িয়ায় পদ্মা নদীর ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। শনিবার ও গতকালের ভাঙনে শুভগ্রাম, বাঁশতলা, পূর্বনড়িয়া ও উত্তর কেদারপুর গ্রামের বিভিন্ন এলাকা নদীগর্ভে চলে গেছে। এতে ৭০টি পরিবার গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। এ নিয়ে গত তিন মাসে পদ্মার ভাঙনে নড়িয়ার তিনটি ইউনিয়নে ও পৌরসভার দুটি ওয়ার্ডে ৬ হাজার ২০০ পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ল। ভাঙন কবলিত এলাকায় এখন চলছে দুর্গত মানুষের আহাজারি। এদিকে গতকাল সকালে নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর, মূলফত্গঞ্জ, বাঁশতলা ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন শেষে দুপুরে নড়িয়া উপজেলা পরিষদ সভাকক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের (ভারপ্রাপ্ত) সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, ভাঙন ঠেকাতে নড়িয়া-জাজিরা ভাঙন কবলিত এলাকায় বাঁধের কাজ শুরু করবে সরকার। ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করতে এরই মধ্যে একটি ড্রেজার এসে পৌঁছেছে। আজ (সোমবার) থেকে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, নড়িয়া-জাজিরা উপজেলায় ৯ কিলোমিটার ভাঙনের কবলে পড়েছে। তার মধ্যে চার কিলোমিটার বেশি ভাঙছে। আর এই চার কিলোমিটার ভাঙন রোধে সাময়িকভাবে কাজ শুরু করা হবে। তিনি বলেন, নড়িয়া জাজিরা অংশে ৯ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ের কাজ করা হবে। আর ৯ দশমিক ৯০ কিলোমিটার ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ করা হবে।

বাগেরহাট :  বাগেরহাটের চিতলমারীতে মধুমতি নদীর তীব্র আকার ধারণ করছে। নদীতে তীব্র স্রোত ও ঢেউয়ের আঘাতে প্রতিদিন ভাঙনে চিতলমারী উপজেলার শৈলদাহ বাজারের অসংখ্য দোকানপাট, বসতবাড়ি, ফসলি জমি নদীতে বিলীন হচ্ছে। তীব্র নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে ঢাকা-পিরোজপুর মহাসড়ক। ফলে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে এ মহাসড়ক। যে কোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে যান চলাচল। ভাঙনকবলিতদের অনেকেই জানান, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে চিতলমারী উপজেলার কলাতলা ইউনিয়নের শৈলদাহ বাজার ও বড়বাড়িয়া ইউনিয়নের পরানপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মধুমতি নদীর ভাঙন শুরু হয়।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে নদী ভাঙনে সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের প্রায় ১০০ একর আবাদি জমি ও ২৫টি বসতবাড়ি ধরলা নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙনের তীব্রতা এতই বেশি যে ঘড়বাড়িগুলো সরিয়ে নেওয়ার সময়ও  মেলেনি। হাতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সবকিছু অবহিত করা হয়েছে। তবে ভাঙন রোধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বগুড়া : বগুড়ায় যমুনা নদী রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে। পানি বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় নদীর কাছাকাছি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে বহু পরিবার আশ্রয় নিচ্ছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলা কৃষি অফিস বলছে, এখন পর্যন্ত ৬২২ হেক্টর জমিতে পানি প্রবেশ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলার পাশাপাশি সোনাতলা ও ধুনট উপজেলা যমুনা নদী পয়েন্টেও পানি বাড়ছে। চরাঞ্চলে নিম্নাঞ্চলের ফসলি জমিতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। ধুনটের বন্যা পরিস্থিতিও অপরিবর্তিত রয়েছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও করতোয়ার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তিস্তা, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্রের চর ও নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। তলিয়ে গেছে কৃষি জমি। এ পর্যন্ত জেলায় মোট ১ হাজার ১০০ হেক্টর কৃষি জমি তলিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। মেঘলা বেগমদের  ঠিকানা কোথায়? খোলা আকাশের নিচে চোখের পানি ফেলছিলেন, আর ছাই দিয়ে থালাবাসন মাজছিলেন নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের চরজুজিরা গ্রামের মেঘলা বেগম। কারণ জানতে চাইলে তিনি ডুকরে কান্না শুরু করেন। বলেন, একদিকে পদ্মার ভাঙন, আরেকদিকে এনজিওর কিস্তি হাঙ্গরের মতো হামলে পড়ছে। মেঘলা বেগম জানান, স্বামী শহীদুল ইসলাম, সন্তান, ভাই ও মাসহ এক খণ্ড জমি নিয়ে সুখেই কাটছিল সংসার। স্বামী কৃষিকাজ করতেন। তার ভাই রিকশা চালাত। সেই আয় দিয়ে সংসার চলত তার। হঠাৎ একদিন সেই জমিটুকু পদ্মার নদীগর্ভে চলে যায়। তারপর এক বুক হাহাকার নিয়ে সেখান থেকে প্রথমে কেদারপুর লস্কর বাড়ির বাগানে আশ্রয় নেওয়া হয়। সেই বাগানও নদীগর্ভে চলে যায়। এখন পরিবার নিয়ে কেদারপুর মিয়াবাড়ির মাঠে খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নিয়েছেন তিনি। মেঘলা বেগম বলেন, ‘একটি এলাকায় আমরা অনেকেই বাস করতাম। সবার বাড়িঘর যা ছিল তা নদীতে ভেঙে নিয়ে গেছে। দুবার ভাঙার পর এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি আমরা। অনেক কষ্ট হয় খোলা আকাশের নিচে থাকতে। আগে তিন বেলা খেতাম, এখন এক বেলা খেয়ে আছি। দিন হলে রোদে পুুরি, বৃষ্টিতে ভিজি। আর রাতে পোকার কামড় খাই। কোনো বিদ্যুতের আলো নেই। চোরের ভয়ে রাত জেগে থাকতে হয়। আমার দুই বছরের একটি সন্তান আছে। এখানে কোনো বিছানা নেই। রাতে অন্ধকারে ছেলেকে নিয়ে মাটিতে থাকতে হয়।’

তিনি জানান, স্বামী কৃষিকাজ করত, ভাই রিকশা চালাত। এখন রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় এবং ফসলি জমি নদীতে চলে যাওয়ায় কাজও বন্ধ। তিনি বলেন, ‘নদী ভেঙে যাওয়ায় অনেক গরিব হয়ে গেছি। এত কষ্ট তার ওপর আবার কিস্তি। এই বিপদের দিনেও প্রতিদিন স্যারেরা আসেন কিস্তির জন্য। কিস্তি না দিলে খুব খারাপ আচরণ করেন। আর কিছু দিন পরে যদি কিস্তিগুলো নিত, তাহলে ভালো হতো। আর সরকার যদি সাহায্য করত, আমরা তাহলে বাঁচতে পারতাম।’ মিয়াবাড়ির মাঠে খোলা আকাশের নিচে মেঘলা বেগমের পরিবারের মতো বসবাস করছে অন্তত ১০টি ভাগ্যাহত পরিবার। বসতভিটা হারানোয় মানুষগুলোর বুকজুড়ে শুধুই কান্না, শুধুই হাহাকার। দুই সপ্তাহ আগেও বাপ-দাদার বসতবাড়িতে বাস করতেন তারা। ৬ সেপ্টেম্বর পদ্মার প্রবল ভাঙন শুরু হয়। সেই ভাঙনে কপাল ভাঙে সবার। ভাঙনে বাপ-দাদার ঘরবাড়ি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। কোনো রকমে কেবল ঘরের আসবাবপত্র সরানো গেছে। কিন্তু চিরতরে হারিয়ে গেছে ভিটেমাটি আশ্রয়। সব হারিয়ে এখন তারা পরের জমিতে খোলা আকাশের নিচে। তারা জানান, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথার ওপর ছাপড়া দিয়ে সন্তান, বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। গত ১০ দিনে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি পারিবারকে ৩০ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে। ৩০ কেজি করে চালে তাদের এত বড় সংসার চলছে না।

তারা বাঁচতে চান, একটু আশ্রয় চান। তারা আরও জানান, পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন রোগে ভুগছে। তারা বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিল। এই দুর্ভোগেও কিস্তির সাহেবরা পিছু ছাড়েননি। হায়েনার মতো তারা হামলে পড়ছেন। ভুক্তভোগী রাশ মনি দাস জানান, তার স্বামী মূলফত্গঞ্জ বাজারে মাঠার দোকান করতেন। এক মাস সাত দিন হলো আমাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট নদীতে চলে গেছে। সব হারিয়ে কেদারপুর মিয়াবাড়ির মাঠের রাস্তার পাশে কোনো রকম মাথা গুঁজেছেন। জীবন বাঁচাতে স্বামী বাজারে বাজারে গিয়ে বাদাম বিক্রি করছেন। এতে সংসার চলে না। তার ওপর কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা খাইতে পাই না, কিস্তি দিমু কেমনে? প্রত্যেক দিন কিস্তির স্যারেরা আসে, গলা চেপে ধরার মতো চেপে ধরে।’ রাশ মনির কথা, ‘এই সময়টা যদি কিস্তিটা বন্ধ রাখা যেত, কত না ভালো হতো।’

তিনি জানান, এক বছর ধরে প্যারালাইসিসে ভুগছেন। চিকিৎসার জন্যই স্বামী কিস্তি তুলেছিলেন। কিন্তু এখন সেই কিস্তি গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ ভাঙন কবলিতরা যখন খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটাচ্ছেন, তখন কিস্তি আর সুদের টাকা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চড়া সুদে টাকা এনে অনেকেই কৃষিকাজ ও ব্যবসা করছিলেন। কিন্তু নদী ভাঙন সব কেড়ে নিয়েছে। এখন কিস্তির টাকা নিয়ে তারা মহাবিপাকে। জানা গেছে, এরকম বিপাকে রয়েছে কয়েকশ পরিবার। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, জীবন বাজি রেখে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন ভাঙন কবলিতরা। তাদের খাবার নেই, নেই শিশুদের ওষুধ খাওয়ানোর টাকা। এমনকি যুবতী মেয়েদেরও নেই কোনো নিরাপত্তা। যদিও পুলিশ প্রশাসন দাবি করছে, সব রকম নিরাপত্তা দিতে কাজ করছে পুলিশ। নড়িয়া থানার ওসি আসলাম উদ্দিন বলেন, ভাঙন কবলিতদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরও পুলিশ মোতায়েন করা হবে। এদিকে জেলা প্রশাসন বলছে, আগামী পাঁচ মাস ভাঙন কবলিত এলাকায় ঋণ দেওয়া কোনো সংস্থা, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কিস্তি আদায় বন্ধ রাখবে। কিন্তু ব্যুরো বাংলা, আশা, গ্রামীণ ব্যাংকসহ বিভিন্ন এনজিও, ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি ঠিকই ভাঙন কবলিতদের কিস্তির টাকার জন্য প্রতিদিন চাপ দিচ্ছে। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়