ডেস্ক রিপোর্ট : পাঁচটি ট্রেডে (বিষয়) প্রশিক্ষণ দিতে ৪০ জন করে মোট ২০০ জনের নামের তালিকা বানানো হয়। নির্ধারণ করা হয় প্রশিক্ষণের স্থান, নাম। তৈরি করা হয় পৃথক পাঁচটি প্রকল্প। প্রকল্পগুলো অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে। যথারীতি প্রকল্পগুলো অনুমোদিত হয়ে আসে। এরপর অফিসের চেয়ার-টেবিলে বসে এক মাসের মধ্যেই শেষ করা হয় সেই প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণার্থীদের নামে ইস্যু করা সনদপত্রও গায়েবি বিতরণ করা হয়।
এভাবে গত জুন ক্লোজিংয়ের মাসে প্রশিক্ষণ কোর্সের বিপরীতে বরাদ্দ করা পুরো টাকাই গায়েব করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। বগুড়ার শেরপুর উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসে অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র এটি। অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন অফিসের প্রধান কর্মকর্তা। পরে এই অনিয়মের সঙ্গে জড়ান প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তা।
অভিযুক্ত শেরপুর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা বিজয় চন্দ্র দাস বলেন, ‘পাঁচটি ট্রেডের মধ্যে তিনটিতে অনিয়ম হয়েছে। পরে নতুন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে দুটি ঠিকঠাক করা হয়। সময় না থাকায় একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ঠিক করা সম্ভব হয়নি।’ এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে কত টাকা ব্যয় করা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য তিনি জানাতে পারেননি। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাঁচটি ট্রেডের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল পাঁচ লক্ষাধিক টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর শেরপুর উপজেলা কার্যালয়ে কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্পের আওতায় পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ প্রশিক্ষণ কোর্সের অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়। প্রকল্পগুলো হলো উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের শালফা ওয়েসিস কোচিং সেন্টারে কাঠমিস্ত্রি প্রশিক্ষণ (২১ দিন), সাতরা ব্র্যাক স্কুলে বাঁশ ও বেতের কাজবিষয়ক প্রশিক্ষণ (২১ দিন), পারভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোমবাতি তৈরি প্রশিক্ষণ (১৪ দিন) ও আলতাদিঘি বোর্ডেরহাট ফাজিল মাদরাসায় গরু মোটাতাজাকরণ প্রশিক্ষণ (সাত দিন)। পঞ্চম ট্রেডটিও ছিল গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের।
প্রতিটি প্রশিক্ষণ কোর্সে ৪০ জন করে মোট ২০০ জনের নামের তালিকা পাঠানো হয়। একই অর্থবছরের জুন মাসে প্রকল্পগুলো অনুমোদিত হয়ে আসে; কিন্তু কোনো প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়নি।
এদিকে বগুড়া জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালকের (ডিডি) কার্যালয় থেকে ওই পরিমাণ (২০০) ফাঁকা সনদপত্র আসে। শেরপুর কার্যালয় থেকে সনদপত্রে ২০০ জনের নাম উল্লেখ করে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সনদপত্রগুলো জেলা কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেন। পরে ডিডি তাঁর স্বাক্ষর দিয়ে পুনরায় সনদপত্রগুলো শেরপুর কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেন। প্রত্যেকের নামে ইস্যু করা সনদপত্রগুলো রেজিস্টারে বিতরণ দেখানো হয়। এভাবে এই প্রশিক্ষণে বরাদ্দ পুরো টাকাই ভাগবাটোয়ারা করে নেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
শেরপুর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা বিজয় চন্দ্র দাস, তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তা, চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালক, দুজন সহকারী উপপরিচালক (এডি), তৎকালীন শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলার বেশ কয়েকটি দপ্তরের কর্মকর্তাকে এসব প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসেবে কাগজে-কলমে অংশগ্রহণ দেখানো হয়। বিনিময়ে তাঁদের কাছে সম্মানী পৌঁছে দেন বিজয় চন্দ্র দাস নিজেই। তিনি বলেন, তাঁর অধীনস্থদের কারণে কিছু ভুল হয়েছে। অনেক ভুল শুধরে নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু ভুল এখনো রয়েছে। সময়ের অভাবে শুধরে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালক দিরাজ চন্দ্র সরকার (চলতি দায়িত্ব) বগুড়ায় নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করলেও তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না।
শেরপুর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা বিজয় চন্দ্র দাস এ উপজেলায় ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি যোগ দেন। এখানে তাঁর চাকরি সাত বছর হলেও তাঁকে অন্যত্র বদলি হতে হয়নি। তাই তিনি বিভিন্ন অপকর্ম করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ।
এই পাঁচটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের বিষয়ে খোঁজ জানা গেছে, সাতরা ব্র্যাক স্কুলে বাঁশ ও বেতের কাজবিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীর তালিকায় ১১ নম্বর ব্যক্তি বিনোদপুর গ্রামের গোলাম আজমের ছেলে ইমরান আলী। ইমরান বলেন, তিনি কখনোই এ প্রশিক্ষণে অংশ নেননি। এমনকি তাঁর ছবি ও ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপিও (তালিকা তৈরির আগে প্রয়োজন) তিনি ওই অফিসে দেননি। তালিকায় তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা দেওয়া আছে এইচএসসি পাস, অথচ তিনি এসএসসি পাসও করেননি। আবার তালিকায় আরেকজনের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি লেখা থাকলেও তিনি মাস্টার্স পাস।
তালিকায় ১০ নম্বর ব্যক্তি জুয়েল রানার ঠিকানায় ওমরপাড়া লেখা হলেও তিনি বিনোদপুরের বাসিন্দা। আর ওমরপাড়ার বাসিন্দা আলমগীর ও শফিকুল ইসলাম হলেন যথাক্রমে সুঘাট ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। যোগাযোগ করা হলে তাঁরা বলেন, তাঁরা কেন বাঁশ ও বেতের প্রশিক্ষণ নেবেন। তাঁদের বংশে ও গ্রামে কেউ বাঁশ ও বেতের কাজ করেননি।
অনুরূপভাবে কাঠমিস্ত্রি প্রশিক্ষণ, মোমবাতি তৈরি ও গরু মোটাতাজাকরণ প্রশিক্ষণের তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে তাঁরাও এ প্রশিক্ষণে অংশ নেননি। প্রশিক্ষণের জন্য যেসব ভেন্যুর নাম ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিশ্চিত করেছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম জানান, কেউ অভিযোগ দিলে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র : কালের কন্ঠ
আপনার মতামত লিখুন :