ডেস্ক রিপোর্ট : গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সংযোজনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ৩৫তম সভা ছিল ৩০ আগস্ট, বৃহস্পতিবার। এই সভাকে ঘিরে সকাল থেকেই সাংবাদিকদের ভিড় কমিশনে। বেলা ১১টা ১০ মিনিটে সভা শুরু হয়ে বিকেল ৫টায় শেষ হয়। এরপর ইসি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করে বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশনে ইভিএম কেনার প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। এটা পুরো কমিশনের অনুমোদনে পাঠানো হয়েছে কি না?’
জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘পুরো কমিশনের অনুমোদনে প্রকল্প পাস হয়েছে।’
সিইসির ওই বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে নিজ কার্যালয়ে কথা বলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি কমিশন সভা শুরুর প্রায় ২০ মিনিট পর জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন।
মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, দেড় লাখ ইভিএম কিনতে তিন হাজার ৮২৯ কোটি ৭ লাখ টাকার প্রকল্প পাসের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। পূর্ণ কমিশনের সম্মতিতে প্রকল্প পাস হয়েছে কি না, সে বিষয়েও তিনি কিছু জানেন না।
মাহবুব তালুকদারের ভাষ্য, ‘কাগজ কোথায়? আমি তো জানি না।’
মাহবুব তালুকদারের এমন বক্তব্যের পর প্রিয়.কমের পক্ষ থেকে পাঁচ কমিশনারের মধ্যে অন্য চারজনের (সিইসিসহ) সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে সিইসির ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। অন্য তিন কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়।
কমিশনারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাঁচজনের মধ্যে তিনজন প্রকল্প পাসের বিষয়ে জানতেন। দুই কমিশনার (মাহবুব তালুকদার ও রফিকুল ইসলাম) প্রকল্প পাসের বিষয়টি জানতেন না।
কয়েকদিন আগে কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, তিনি ইভিএমের প্রকল্প পাসের বিষয়ে কিছু জানেন না। বৃহস্পতিবার মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যের পর রফিকুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, ইভিএমের এই প্রকল্প কমিশন সভায় পাস হয়নি। এটা ফাইলে ফাইলে পাস হতে পারে। আর যে সময় পাস হয় প্রকল্পটি, তখন তিনি কমিশনে উপস্থিত ছিলেন না।
অন্য দুই কমিশনার কবিতা খানম ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদাত হোসেন চৌধুরী জানান, ফাইলে ফাইলে নয়, ইভিএমের এই প্রকল্প পাস হয়েছে কমিশন সভায়।
চার কমিশনারের বক্তব্য
সিইসির সংবাদ সম্মেলনের পর কমিশনার মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সিইসি যা কিছু বলেন, তার কোনোটারই আমি কখনো প্রতিবাদ করব না। সিইসির বক্তব্যের বিপরীতে কোনো বক্তব্য আমি কখনো দেবো না এবং আমি কখনোই কমিশনের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে দিতে চাই না। এই ধরনের প্রশ্ন আমাকে করাটা একটু বিব্রতকর।’
কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
এই কমিশনার আরও বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশনে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, এটা যদি পুরো কমিশনের অনুমোদন হয়ে থাকে...। প্রতিটি কমিশন সভার একটি করে কার্যবিবরণী আছে। কোন সভার, কোন কার্যবিবরণীতে, এটা (ইভিএম প্রকল্প অনুমোদন) আছে? আমি তো দেখলাম না।
যাই হোক, আমি এমন কোনো কথা বলতে চাই না, যে কথা আমার আরেকজন সহকর্মীর কথার বিপরীতে দাঁড়ায়। আমি যে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি, এটা কারো বিরুদ্ধে নয়। একটা মতের বিরুদ্ধে আমার একটা ভিন্ন মত।’
কততম কমিশন সভায় ইভিএম প্রকল্প পাস হয়েছে জানতে চাইলে কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এ ধরনের প্রশ্ন যদি জিজ্ঞাস করেন, তাহলে সচিব কাজ করে। কমিশনের সবকিছু কমিশন সভায় অনুমোদন হয় না, এটা ফাইলের মাধ্যমেও অনুমোদন হয়। এটা যদি জিজ্ঞাস করেন আমারে, তাহলে ভুল করবেন। কারণ এই জিনিস আমরা মাথায় নিয়ে বসে থাকি না।’
কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম।
‘কয়দিন আগে আপনি বলেছিলেন, কমিশন সভায় পাস হওয়ার বিষয়টি আপনি জানেন না। তাহলে আজকে সিইসি স্যার বলেছেন, প্রকল্পটি কমিশন সভায় পাস হয়েছে’-এমন প্রশ্নের উত্তরে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আপনাকে তো বললামই, ফাইলের মাধ্যমেও তো কমিশনের অনুমোদন নেয়। কমিশন সভা না কিন্তু, কমিশনের অনুমোদন নেওয়া হয়।
কমিশনের অনুমোদন যখন ফাইলের মাধ্যমেও নেওয়া হয়, তখন যদি আমরা কেউ একজন উপস্থিত না থাকি, ওই সময় আমার পিএস (একান্ত সচিব) সাহেবকে এমপাওয়ার্ড (ক্ষমতায়ন) করা আছে, উনি লিখে দেবেন বাইরে, সফরে। পাঁচজন কমিশনারের মধ্যে তিনজন কমিশনারের দস্তখত থাকলে এটা কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে গৃহীত হবে। আমি বলছিলাম যে, আমি জানি না, কারণ তখন ছিলাম না হয়তো।’
কততম সভায় ইভিএমের প্রকল্প পাস হয়েছে, তা জানেন না অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদাত হোসেন চৌধুরীও। কিন্তু তার দাবি, কমিশন সভাতেই ইভিএম প্রকল্পের বিষয়টি পাস হয়েছে।
কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদাত হোসেন চৌধুরী
শাহাদাত হোসেন চৌধুরী প্রিয়.কমকে বলেন, ‘কততম সভায় ইভিএম প্রকল্পের বিষয়টি পাস হয়েছে, এটা তো মুখস্ত নাই। কমিশন সভায় অনুমোদন না হয়ে এত বড় প্রকল্প কি (পরিকল্পনা কমিশনে) পাঠানো যায়? এটা আমাকে জিজ্ঞেস না করে এটা অফিস থেকেই জানতে পারবেন। ওগুলো তো মুখস্ত রাখা যায় না কততম কমিশন সভায়। কিন্তু এটা কমিশন সভায় পাস হয়েছে।’
কমিশনার কবিতা খানম।
কমিশনার কবিতা খানম বলেন, ‘কততম সভায় পাস হয়েছে, এটা মুখস্ত আছে নাকি? প্রকল্পটা সম্ভবত কমিশন সভায় পাস হয়েছিল। ফাইলে ফাইলে পাস হবে কেন? ইভিএম নিয়ে এত প্রশ্ন কেন, এত প্রশ্ন থাকতে? কত তারিখে পাস হয়েছে, কততম সভায় পাস হয়েছে, এগুলো কি না দেখে বলা সম্ভব? সন্দেহ আছে, সে জন্য জানার চেষ্টা করছেন? পাস হয়নি কমিশন সভায়? কমিশন সভায় পাস হয়েছে, এটা বলা যায়। কিন্তু কততম সভায় পাস হয়েছে, এটা উইদাউট রেকর্ড (কাগজপত্র ছাড়া) কীভাবে বলব?’
সব কমিশনারের সম্মতি ছাড়া কি প্রকল্প অনুমোদন করা যায়?
সব কমিশনারের সম্মতি ছাড়া ইসি কোনো প্রকল্পের অনুমোদন দিতে পারে কি না, তা জানতে চাওয়া হয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপিপন্থী আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের কাছে। তিনি বলেন, ‘কমিশনের পাঁচজনের মতামতই হতে হবে, তাহলে পরে পূর্ণ কমিশনের মত হবে। নির্বাচন কমিশনের মতের সংবিধানে কোনো বিধান নাই। কমিশনের সিদ্ধান্তে কোনো একজন বিরোধিতা করলে তাকে কমিশনের সিদ্ধান্ত বলা যাবে না।’
জয়নুল আরও বলেন, ‘৩৮০০ কোটি টাকা, এটা পাবলিক মানি (জনগণের টাকা)। এটা কেন ইভিএমের পেছনে খরচ করা হবে? নির্বাচন যদি সুষ্ঠুভাবে করতে চায়, তাহলে তো অনেক ব্যবস্থা আছে। তো এখানে ইভিএম সিস্টেম দেখানো হলো। পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে, ইভিএমে ভোট দেওয়ার কাজটির চেয়ে গণনার কাজটি গুরুত্বপূর্ণ। দেখা গেল, ভোট গণনা করে একটি দলকে হাতিয়ে দিলেন। সে জন্য যারা নির্বাচন কমিশনে আছে, তাদের মধ্যেও একটু সন্দেহ জাগছে। এ জন্য তারা এটার প্রতিবাদ করছেন।’
আওয়ামীপন্থী একজন আইজীবীর কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
যা আছে প্রকল্পে
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পের নাম ‘নির্বাচন ব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়, সংরক্ষণ ও ব্যবহার প্রকল্প’। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে কমিশনের। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এক ধাপে এই প্রকল্পের আওতায় দেড় লাখ ইভিএম কিনতে প্রাক্কলিত প্রকল্পের ব্যয় তিন হাজার ৮২৯ কোটি সাত লাখ টাকার প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
এর মধ্যে মোটর যানবাহনে ব্যয় তিন কোটি ৩২ লাখ ২০ হাজার, ইভিএম কিনতে তিন হাজার ৫১৫ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার (প্রতিটি ইভিএমের দাম পড়বে দুই লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ দশমিক ৬৭ টাকা), অফিস সরঞ্জামাদিতে আট লাখ ৮০ হাজার, কম্পিউটার সফটওয়্যারে ৫০ কোটি ৯০ লাখ, আসবাবপত্র ক্রয়ে ৭৫ কোটি ৩৩ লাখ, মূল্য সংযোজন করে (ভ্যাট) ৫০ লাখ এবং প্রত্যাশিত ব্যয় ৪১ কোটি ৭৫ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।
বিশাল অঙ্কের এই প্রকল্পটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বহির্ভূত। সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকারের (জিওবি) অর্থায়নে প্রকল্পটি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণে মন্ত্রীর সম্মতি নেওয়া হয়েছে বলেও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
যত সীমাবদ্ধতা
এই প্রকল্পের সীমাবদ্ধতাগুলো পরিকল্পনা কমিশনের মতামত/ মন্তব্যে ওঠে এসেছে। গত ১৬ আগস্ট, বৃহস্পতিবার পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্যামস্টেক উইংয়ের যুগ্ম-প্রধান ড. সেলিনা আক্তার স্বাক্ষরিত মতামত/মন্তব্যে বলা হয়, প্রকল্পটির গ্রহণের বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি।
এই মতামত/মন্তব্যে আরও জানতে চাওয়া হয়, প্রকল্পে ২০৪ জন পরামশর্কের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি। সেই সঙ্গে ইভিএম সিস্টেম ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি কেনার জন্য তিন হাজার ৫১৫ কোটি ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকার ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তির বিষয়ে পিইসির সভায় আলোচনার কথাও বলা হয়েছে। এসব ইভিএম সিস্টেম ও যন্ত্রপাতি সরাসরি কোথা থেকে, কীভাবে কেনা হবে, সেটাও জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
এই প্রকল্পে তিন হাজার ১১০ জনকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ কাদের প্রদান করা হবে, সে বিষয়ে আলোচনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পে ৩০ জনের বৈদেশিক শিক্ষা সফর/ প্রশিক্ষণের সংস্থান রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারা বৈদেশিক সফরে অংশ নেবেন, সে বিষয়েও আলোচনা করতে বলা হয়।
প্রচার ও বিজ্ঞাপন, পরিবহন, মোটর যানবাহন কেনা, কম্পিউটার সফটওয়্যার ও আসবাবপত্র কেনাসংক্রান্ত কাজে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ (৩১৩ কোটি ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা) ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে, সে বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনার জন্যও বলা হয়েছে।
এ রকম প্রেক্ষাপটে গত ১৯ আগস্ট কোনো কারণ উল্লেখ না করে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য মুহাম্মদ দিলোয়ার বখ্তের সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভাটি বিশেষ কারণে স্থগিত করা হয়। আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্যামস্টেক উইংয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রধান রনি রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। সূত্র : প্রিয়.কম
আপনার মতামত লিখুন :