শিরোনাম
◈ অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধে বিটিআরসিতে তালিকা পাঠানো হচ্ছে: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ◈ পাবনায় হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি ◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সব সম্পত্তি দিয়ে দেবো (ভিডিও) ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ আইনজীবীদের গাউন পরতে হবে না: সুপ্রিমকোর্ট ◈ তীব্র গরমে স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা আরও ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা ◈ সিরিয়ায় আইএসের হামলায় ২৮ সেনা নিহত ◈ সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, পতন অনিবার্য: রিজভী 

প্রকাশিত : ২৮ আগস্ট, ২০১৮, ০৮:১২ সকাল
আপডেট : ২৮ আগস্ট, ২০১৮, ০৮:১২ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

প্রশ্নটি জয়-পরাজয়ের

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : দেশে জাতীয় নির্বাচন তো মনে হয় ঘনিয়ে এসেছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরেই হবে বলে ধারণা। তাতে কে জিতবে, কীভাবে জিতবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা আছে; কিন্তু যে দলই জিতুক এটা নিশ্চিত যে, হেরে যাবে জনগণ। নির্বাচন শেষ হতে না হতেই তারা জেনে যাবে যে, তারা হেরে গেছে।

ঘটনাটা নতুন নয়। খুব বড়, একেবারে ঐতিহাসিক দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা এ দেশের জনগণের আছে, একটি ১৯৪৬-এর, অপরটি ১৯৭০-এর; দুটিতেই জনগণের মনে হয়েছিল যে তারা জিতেছে, ভেবেছিল তাদের মুক্তি আসবে। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল, মুক্তি আসেনি। তারা হেরে গেছে। '৪৬-এর ঠিক আগে অখণ্ড বাংলায় একটা প্রায়-বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, নির্বাচন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, তাতে সাফল্য যে আসেনি তা নয়। নির্বাচন হয়েছে, বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু তারপরেই দাঙ্গা, একটু পরে দেশভাগ। আর '৬৯-এ তো একটা অভ্যুত্থানই ঘটেছিল। গ্রামের মানুষ জেগে উঠেছিল। থরথর করে কাঁপছিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান। মনে হয়েছিল বিপ্লব ঘটবে। সশস্ত্র শাসকরা প্রশমন চেয়েছে, তারা নির্বাচন দিয়েছে, দ্রুতগতিতে। এ নির্বাচনও বিশ্বাসযোগ্য ছিল। কিন্তু এবারের পরিণতি দাঁড়াল আরও ভয়ঙ্কর; দাঙ্গা নয়, সামনাসামনি যুদ্ধ। সেবার দেশ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, এবার রাষ্ট্র ভাঙল। কিন্তু জনগণের মুক্তি এলো না। এবারও তারা হেরে গেল। হারল যে সেটা কার কাছে? হারল ব্যবস্থার কাছে। ব্যবস্থাটা পুঁজিবাদী। ১৯৪৬-এর পরে পুঁজিবাদ বিকাশের নতুন পথ পেল, ১৯৭১-এর পরে পুঁজিবাদ তার বিকাশের পথটাকে আরও প্রশস্ত করে নিল; এখন তো তার অগ্রযাত্রা পুরোপুরি অপ্রতিহত।

কিন্তু এ রকমই কি চলবে? জনগণ কি কেবল হারতেই থাকবে? হারার কোনো শেষ থাকবে না? না; তা হবে না। জনগণ জিতবে। আগামী নির্বাচনে যে জিতবে না এটা নিশ্চিত, আগামী দশকেও জিতবে না। কিন্তু জিতবেই জিতবে। ব্যবস্থাটা অবশ্যই বদলাবে। কবে এবং কীভাবে, প্রশ্ন শুধু সেটাই।

এই আশাবাদের কারণ কী? কারণ একাধিক। প্রথম কারণ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা অনেক, তারাই ৯০ জন; তাদের তুলনায় সুবিধাভোগীদের সংখ্যা খুবই কম, শতকরা দশজন। হ্যাঁ, এই ৯০ জন আগেও ছিল। কিন্তু তারা আগে এতটা বিক্ষুব্ধ ছিল না। বিক্ষোভের সঙ্গে মিলেছে সচেতনতা। আর এই বিক্ষোভ ও সচেতনতা কোনো এক দেশের মানুষের নয়, এটি এখন বিশ্বময়। সারাবিশ্বের বঞ্চিত-অত্যাচারিত মানুষ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। লড়াইটা চলছে প্রত্যেকটি দেশের অভ্যন্তরে। কোনো দেশের মানুষই সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা আর চায় না, সামাজিক মালিকানা চায়। দমিয়ে দেওয়ার, দাবিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। চলবে। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হবে না। নদীর ওপর বাঁধটা টিকবে না; কারণ স্রোত প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে এবং প্রবল হতেই থাকবে। বাঁধটা ভেঙে পড়বে।

আশাবাদের দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা এখন চরম জায়গাতে এসে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে সে যে ভেঙে পড়েনি তার কারণ, তার বুদ্ধিতে যত ছল ছিল, বাহুতে যত বল ছিল, কৌশল উদ্ভাবনায় যত দক্ষতা ছিল, সব সে খাটিয়েছে। তার আয়ত্তে এখন যা আছে তা তলানি বটে। দিশেহারা দশাতে এখন সে কতটা যে বেপরোয়া, সেটা বোঝা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৎপরতায়। পুঁজিবাদ এখন রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে মানুষের বিক্ষোভ দমনের জন্য। রাষ্ট্র পরিণত হচ্ছে ফ্যাসিবাদী শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রতিষ্ঠানে। করতলগত মিডিয়াকে সে ব্যবহার করছে বিভ্রান্তি ও ভোগবাদিতা প্রচারের বাহন হিসেবে। ফেসবুক, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার আত্মসন্তুষ্টি দানের অন্তরালে মানুষকে কেবলই পরস্পরবিচ্ছিন্ন ও অসামাজিক করে তুলছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তিমানুষের সব খবর ছেঁকে তুলছে গোয়েন্দাগিরির জন্য। বিশ্বযুদ্ধ লাগানোর কাজে ক্ষান্তি দিয়ে এখন সে স্থানীয় যুদ্ধের ব্যবস্থা করছে। সমানে চলছে মানুষ মারার অস্ত্রের উন্নয়ন। আর আছে নেশা। ধর্ম, বর্ণ, অন্ধ জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির পুরনো নেশা তো রয়েছেই, যোগ হয়েছে অত্যাধুনিক নতুন নেশা, সেটা মাদকের। পুঁজিবাদ মুনাফা ছাড়া আর কিছু বোঝে না; মুনাফার প্রয়োজনে দুর্বল মানুষদের সে মজুরি-দাস বানায়। মজুরি-দাসত্ব প্রাচীন ক্রীতদাস প্রথারই আধুনিক রূপ। মানুষরা থেকে থেকে ক্ষেপে ওঠে দেখে, পুঁজিবাদীরা এখন চাইছে মানুষের বদলে যন্ত্রই তাদের হয়ে কাজ করুক। যন্ত্র কখনও অবাধ্য হবে না, এমনকি মজুরিও চাইবে না। কিন্তু যন্ত্রের রাজত্ব কায়েম হলে মানুষ যে আর মানুষ থাকবে না, মালিকরা নিজেরাও যন্ত্রে পরিণত হবে, সে চিন্তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। যন্ত্রকে খাটিয়ে শ্রমিককে বেকার করলে লোকের ক্রয়ক্ষমতা যে হ্রাস পাবে, সেটাও হিসাবের মধ্যে রাখে না।

তবে যাই করুক শেষ রক্ষা হওয়ার নয়। বিশ্বের সর্বত্র এখন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ ফুঁসে উঠছে। সব দেশেই নিজ নিজ উপায়ে মানুষ লড়ছে; লড়াইয়ের ধরনটা স্থানীয়; কিন্তু লড়াইটা আন্তর্জাতিক। এটা না হয়ে উপায় নেই; কারণ পুঁজিবাদ একটা বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা, তার বিরুদ্ধে সংগ্রামও বিশ্বময় ঘটতে বাধ্য। পুঁজিবাদীরা আর এক থাকবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলে এখন আর কিছু নেই, ভেঙে পড়েছে; ইউরোপ ও আমেরিকা আলাদা হয়ে যাচ্ছে; ২০১৮ সালে জি-৭ সম্মেলন শেষ হয়েছে বড় পুঁজিপতি দেশগুলোর ঝগড়াঝাঁটির মধ্য দিয়ে; নব্য পুঁজিবাদী চীন তার বিপুল জনশক্তি ও নবীন উদ্দীপনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে প্রতিযোগিতার বাজারে। পুঁজিবাদের পতনটা সবদিক থেকেই অনিবার্য।

বড় সত্য এটাই যে, পুঁজিবাদীদের মুনাফা-উন্মত্ততা মানুষ, মানবতা ও প্রকৃতি- সবকিছুর সঙ্গেই শত্রুতা করছে, তার দাঁত ও নখ কোনো কিছুকেই রেহাই দিচ্ছে না। ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে শুরু করে ভৌগোলিক প্রকৃতির সমস্ত উপাদানকেই সে পণ্যে পরিণত করে ফেলেছে, যার দরুন কোনো কিছুই আর স্বাভাবিক থাকছে না, ক্ষতিগ্রস্ত ও বিকৃত হয়ে পড়ছে। ফলটা দাঁড়াচ্ছে এই যে, পৃথিবী নামে এই গ্রহটির অস্তিত্বই আজ বিপন্ন। মানুষ এখানে টিকতে পারবে কিনা, সেটাই একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু মানুষকে তো বাঁচতে হবে এবং তাকে মানুষের মতোই বাঁচতে হবে; বাঁচার তাগিদেই মানুষ পুঁজিবাদকে ভেঙে ফেলবে। মানুষের সভ্যতা অতীতে বহু রকমের সংকটের মুখোমুখি হয়েছে; তবে বিশ্বব্যাপী অস্তিত্বের এমন সংকট আগে সে কখনও দেখেনি। কিন্তু এই সংকটও মানুষ অতিক্রম করবে বৈকি। মানুষের অসাধ্য কি?

সব মিলিয়ে যে বিষয়টা সামনে আসছে তা হলো, মানুষের ইতিহাস থেমে যাবে না; পেছনে হটে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, সে যাবে সামনে এগিয়ে। পুঁজিবাদ তাই শেষ কথা নয়। পুঁজিবাদের বিকল্প পুঁজিবাদ হবে এমনটা সম্ভব নয়, তাকে সংশোধন করে যে খাড়া করে রাখা যাবে, এটাও হওয়ার নয়। দাসব্যবস্থা ভেঙে যেমন সামন্ত ব্যবস্থা এসেছে, সামন্ত ব্যবস্থা ভেঙে প্রতিষ্ঠা ঘটেছে পুঁজিবাদের, ঠিক তেমনিভাবে পুঁজিবাদকে হটিয়ে দিয়ে নতুন এক ব্যবস্থাকে আসতেই হবে। এই নতুন ব্যবস্থা হবে সমাজতান্ত্রিক। সমাজতান্ত্রিক না হয়ে উপায় নেই। কারণ হাজার হাজার বছর ধরে দাসব্যবস্থা, সামন্তব্যবস্থা ও পুঁজিবাদের ভেতর দিয়ে যে ব্যক্তিমালিকানার কর্তৃত্ব ছিল সেই মালিকানাকে অক্ষুণ্ন রেখে ইতিহাসের পক্ষে আর এগোবার উপায় নেই। ওই ব্যবস্থা ভেঙে যা আসবে সেটা সামাজিক মালিকানা ব্যবস্থা। সামাজিক মালিকানা ব্যবস্থায় মানুষের সৃষ্টিশীলতা অবারিত হবে, প্রাচুর্য দেখা দেবে বিশ্বজুড়ে, মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে উৎপাদনের ও প্রকৃতির বিচ্ছিন্নতা দূর হবে, অবসান ঘটবে অভাব ও সংঘাতের, যুদ্ধ পরিণত হবে অতীত ইতিহাসে; মানুষের উৎপাদিকা শক্তিকে পুঁজিবাদীরা উন্নতির যে স্তরে নিয়ে গেছে, সেখান থেকে সে চলে যাবে উন্নততর এক স্তরে। থাকবে সৃষ্টিশীলতার বিপুল অবকাশ। প্রয়োজনের জগৎ থেকে মানুষ চলে যাবে স্বাধীনতার জগতে।

এটা অনিবার্য। প্রশ্ন হলো- কবে ঘটবে, কীভাবে ঘটবে এবং কেমন করে অবধারিতকে ত্বরান্বিত করা যাবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজবিশ্নেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়