মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ
‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’। এই ভূখ-ের প্রধান দুটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে এত ভালবেসে, মমতা আর নির্ভরতায় বুকে একজনই টেনে নিয়েছিলেন, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। বিনিময়ে আমরা তাকে কী দিলাম? একদল হিসেব করে দেখিয়ে দিলামÑতিনি কত হাজার ইসলামি গান লিখেছেন, কত শতবার কবিতায় আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাই তিনি শুধুই দিলসাফ সাচ্চা মুসলিমেরই কবি। শ্যামা সঙ্গীত লিখে নজরুল হিন্দুদের পক্ষ নিয়েছেন এমনও দাবি করা হল। ব্যক্তি আক্রমণ থেকে নজরুলকে মুক্তি দেয়া হল না। তার স্ত্রী মুসলিম নন, তার সন্তানদের নামে ‘ইসলামী’ গন্ধ না থাকায় আমাদের কণ্ঠ আরও ঝাঁঝালো হল ।
১৯১৭ সালে রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হলে তার হাওয়া ভারতবর্ষেও লাগে। নজরুলের লেখনীতে বারবার সাম্যবাদ, মানুষে মানুষে বিভাজনের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কথা এসেছে। কমরেড মুজাফফর আহমেদ তার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। মার্কসবাদের প্রতি তার আগ্রহ প্রকাশও পেয়েছে। কিন্তু, দলীয় সংকীর্ণতার সবসময়ই বিপক্ষে ছিলেন তিনি। দলকানা তিনি কখনও না হলেও ‘কাফের’ হবার নিন্দার তীর দক্ষ তীরন্দাজদের মত সুনিপুণভাবে তাকে বিদ্ধ করেছি ।
প্রেম, সকল দেশের প্রায় সকল কবির কাব্যের উপজীব্য। তেমনই নজরুলের কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে প্রেম এসেছে স্বাভাবিকভাবে। কখনও কখনও এমন কথাও বলা হল যেন নজরুল ‘সিটি বাজানো গলির ধারের প্রমোন্মাদ’ই শুধু নন বরং তিনি ‘প্রেম মদিরায় শরাবি’ গেছেন। কিন্তু, তার প্রেম ব্যক্তিসত্ত্বাকে জয় করে পরামাত্মায় যে ধাবিত করেছেন এটিকে উপেক্ষা করা হল। খোদার প্রেমে যিনি শরাব পিয়েছিলেন তাকেও পানশালার নিয়মিত খদ্দের বলতেও পিছুপা হল না। আরেক দল এলাম নারীবিদ্বেষী নামক নতুন শব্দের ‘কাঁটার মালা’ পরাতে।
বিদ্রোহীরা শুধু অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়ে। তা সত্ত্বেও ‘বিদ্রোহী’ শব্দের প্রতিশব্দ ‘ভায়লেন্সের ভায়োলিন’ বাদক হিসেবে নজরুলকে সাধারণের কাছে ভয়ের কারণ হিসেবে আমরাই পরিচয় করিয়ে দিলাম। যিনি সৃষ্টি সুখের উল্লাসে অধীর ছিলেন, সেই নজরুলকে খ-চিত্রে ‘ভেঙে করি সব চুরে সব চুরমার’ করা উদ্ধত-অহংকারী হিসেবে উপস্থাপন করলাম ।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর বিশ্বকবিকে নিয়ে নজরুলের লেখা অজর সেই শোক গাঁথাটি পড়লে দিব্যি বোঝা যায় এই দুই কবির পারস্পরিক সম্পর্ক অগ্রজ আর অনুজের মমতায় কতটুকু মাখা ছিল। কিন্তু, স্মৃতি বিভ্রম পরবর্তী প্রজন্মকে সচেতন এখনও শিখিয়ে যাচ্ছি ‘রবীন্দ্রনাথই ষড়যন্ত্র করে বিষ খাইয়ে নজরুলকে বাকরুদ্ধ করে দেন, যেন নজরুল সাহিত্য সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথকে হারাতে না পারেন।’
নজরুলকে শুধু বিনাশই নয় পুরোপুরি ধ্বংসের জন্য আমরা বাঙালিরাই অনেক বড় মাপের শক্তিশালী শত্রু। বিদেশী শত্রুর আর দরকার আছে কি?
লেখক: উপ অধিনায়ক, আর্মড ফোর্সেস ফুড এন্ড ড্রাগস ল্যাবরটরী
আপনার মতামত লিখুন :