শিরোনাম
◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ জিয়াউর রহমানের সময়ই দেশে বিভেদের রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়: ওবায়দুল কাদের  ◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসকে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য দুঃখজনক: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল

প্রকাশিত : ২৭ আগস্ট, ২০১৮, ০৭:৫৯ সকাল
আপডেট : ২৭ আগস্ট, ২০১৮, ০৭:৫৯ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কলম্বো থেকে ভারত মহাসাগর তীরে দুর্গের শহর গলে

আনোয়ার সাত্তার: সাউথ সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের শেষ দিন এবং প্রিয় মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার দিন। অপেক্ষার শেষ প্রহরগুলো ছিল খুবই দীর্ঘ। দীর্ঘ দুই বছর সাউথ সুদান জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছি। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সাউথ সুদানের ঘরবাড়ি থেকে পালিয়ে জাতিসংঘের আশ্রয় শিবিরে আশ্রিত উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং তাদের কল্যাণে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করাই ছিল আমাদের মতো শান্তিরক্ষীদের কাজ।

জুবা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে স্থানীয় সময় সকাল ১০ টায় আমি আর মহিউদ্দীন স্যার কেনিয়ান এয়ার ওয়েজের ফ্লাইটে চড়ে বসলাম। অনেক লম্বা পথ। জুবা থেকে কেনিয়ান এয়ার ওয়েজে নাইরোবি। নাইরোবি থেকে ইতিহাদ এয়ার ওয়েজে আবুধাবী। আবুধাবী থেকে শ্রীলঙ্কান এয়ার ওয়েজে কলম্বো পৌঁছানোর কথা ছিল ৯ নভেম্বর স্থানীয় সময় ভোর ৬টায়। ৯ তারিখ সারাদিন শ্রীলঙ্কা অবস্থান করে পরদিন ১০ নভেম্বর স্থানীয় সময় সকাল ৯টার শ্রীলঙ্কান এয়ার ওয়েজের ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছানোর কথা ছিল ঢাকার সময় সকাল ১০টায়। এভাবেই আমাদের ফ্লাইট রুট ঠিক হয়েছিল। যদিও ইউএন ট্রাভেল এজেন্সি থেকে আমাদের রুট দিয়েছিল জুবা, সাউথ সুদান - ইথিওপিয়ার আদিস আবাবা-ইন্ডিয়ার মুম্বাই- ঢাকা। কিন্তু মহিউদ্দীন স্যার অনেক চেষ্টা তদবীরেরে পর ইউএন ট্রাভেল এজেন্সী আমাদের পছন্দের রুট দিল যাতে আমাদের এই সুযোগে শ্রীলঙ্কা ঘোরা হয়ে যাবে এবং আমার প্রিয় এবং ঘনিষ্ঠ একজন মিশন কলিগ, শ্রীলঙ্কা পুলিশের কর্মকর্তা ধাম্মিকা হেরাথ যে মাত্র কয়েক মাস আগে মিশন শেষ করে দেশে ফিরে গিয়েছিল তার সাথে ও দেখা হয়ে যাবে। যদিও এটি খুব সহজ ভ্রমণ হবেনা পুরো ২ রাত আমাদের না ঘুমিয়েই কাটাতে হবে । কিন্তু তারপরও একটি নতুন দেশ দেখার সুযোগ এবং প্রিয় একজন মানুষ ধাম্মিকার সাথে কয়েকমাস পর আবার দেখা হওয়ার একটি সুযোগ হবে।

আবুধাবী এয়ারপোর্টে কয়েকঘন্টার যাত্রাবিরতি ছিল। কিছু কেনাকাটা করে নিলাম। আবুধাবী এয়ারপোর্টটি দুবাই এয়ারপোর্টের মত বড় নয় কেনাকাটার অপশন ও ছিল সীমিত। আবুধাবী থেকে স্থানীয় সময় রাত এগারটায় শ্রীলঙ্কান এয়ার এ চেপে রওনা দিলাম কলম্বোর উদ্দেশ্যে।

৯ নভেম্বর ২০১৭

কলম্বো এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলাম স্থানীয় সময় ভোর ৫ টায়। পুরো রাতটা নির্ঘুম কাটল আকাশে । প্লেনে আমি ঘুমাতে পারিনা। আমার পাশের প্যাসেঞ্জাররা দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল। তাদেরকে আমার ঈর্ষা হচ্ছিল। যাই হোক কলম্বো এয়ারপোর্টে আমাদের রিসিভ করার জন্য শ্রীলঙ্কা পুলিশের ইন্সপেক্টর রওশন উপস্থিত ছিল। ধাম্মিকা এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় বিশ কিমি দূরে থাকে তাই সে ইন্সপেক্টর রওশন কে পাঠিয়েছিল আমাদের রিসিভ করার জন্য। বাইরে ট্যাক্সি অপেক্ষা করছিল। ড্রাইভার বুদ্ধিকা বেশ ভাল ইংরেজি জানে। ইন্টারনেট ডাটাসহ লোকাল মোবাইল ফোন সিম দিল আমাদের। ধাম্মিকা সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। একটি হোটেলে গিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে রওনা দিলাম গলের উদ্দেশ্যে। পথে একটি রেষ্টুরেন্টে সকালের নাশতা সেরে নিলাম। এটি ছিল মুসলিম রেষ্টুরেন্ট। রেষ্টুরেন্টে বেশ কিছু শ্রীলঙ্কান মুসলিম দের দেখলাম। পুরুষরা লুঙ্গি ও মাথায় টুপি পরা ছিল আর মেয়েরা বোরকা পরা ছিল তবে নেকাব পরা নয়। শ্রীলংকানরা প্রায় সব খাবারেই নারকেলের দুধ আর নারকেল ব্যবহার করে। নারকেলের খোসা দিয়ে বানানো বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন অলঙ্কার শ্রীলঙ্কান মেয়েরা পরিধান করে। নারকেল তাদের অন্যতম রপ্তানী পণ্য এবং নারকেলকে তারা তাদের জন্য ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করে। যাই হোক ভিতরে ডিম দিয়ে বানানো মজাদার পরোটা, মুরগীর মাংস, এক ধরণের শ্রীলঙ্কান হপস আর নারিকেল দিয়ে তৈরি অনেকটা আমাদের ভাপা পিঠার মত দেখতে চমৎকার একটি পিঠা দিয়ে ভরপেটে নাশতা করলাম। মুরগীর কারিটার স্বাদ প্রায় আমাদের দেশীয় কারির মতোই। নাশতা শেষে রওনা দিলাম। পথে ধাম্মিকা অপেক্ষারত ছিল। তাকে আমরা গাড়িতে তুলে নিলাম। “ওহ মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, ইট’স বিন লং টু সি ইউ” ধাম্মিকা আন্তরিকভাবে হাগ করল। “ইটস বিন ফোর মান্থস ডিয়ার ফ্রেন্ড, ভেরি হ্যাপী টু মিট ইউ এগেইন” আমি সাড়া দিলাম।

আমাদের গাড়ি চলছিল বাধাহীন। অত্যাধুনিক হাইওয়ে। গাড়ি পারাপারের জন্য ছোট ফ্লাই ওভার আর আন্ডার পাস রয়েছে। কোন ক্রসিং নেই। ছয়লেনের অত্যাধুনিক হাইওয়ে। গাড়ির খুব একটা আধিক্য নেই। আর আমাদের অর্থনীতির লাইফ লাইন ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক এর চারলেনের কাজ আজো সম্পূর্ণ শেষ হয়নি। বাস দাঁড়ানোর জন্য হাইওয়ের পাশে নির্দিষ্ট বাস বে রয়েছে। এই ১১৯ কিমি রাস্তায় কোথাও এক মিনিটের জন্যও থামল না আমাদের গাড়ি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। রাস্তার পাশে কোথাও ময়লা আবর্জনার স্তুপ, পলিথিন, খালি প্লাষ্টিকের বোতল কিছুই দেখলামনা। এসব দেখতে দেখতে আমার অভ্যস্ত চোখে এসব বড্ড অস্বাভাবিক ঠেকল তাও এমন একটি দেশে যে দেশটি আমাদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে খুব উন্নত তাও নয়। এটি আসলে মানসিকতা, রুচি আর সভ্যতার ব্যাপার। আমাদের দেশে যে যত বড় ক্ষমতাবান তার তত ক্ষমতার অরুচিকর অসভ্য প্রদর্শন। গল যতই কাছে আসছিল নয়নাভিরাম দৃশ্যে ততই মোহিত হয়ে পড়ছিলাম। আমাদের সাথে সাথে ছুটে চলেছিল সমুদ্র সৈকত। সৈকতের সাথে সাথে ছুটছিল ভারত মহাসাগর আর সৈকতে মহাসাগরের ফেনিল ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। পৃথিবীটা কতইনা সুন্দর!

গল পৌঁছে প্রথমে গেলাম ভারত মহাসাগর তীরে ছোট একটি সৈকত যার পাশেই অস্থায়ী একটি মাছবাজার। জানা অজানা হরেক রকম রঙ বেরঙের মাছ সাজানো ছিল দোকান গুলিতে। ইশ ! কিছু মাছ যদি নিয়ে আসতে পারতাম ! সৈকতে একটির পর একটি মাছ ধরার নৌকা আসছিল আর মাছ নামাচ্ছিল। সৈকতের পাশেই ছিল ভ্রাম্যমাণ ডাব বিক্রেতা। ধাম্মিকা আমাদের সবাইকে ডাব খাওয়াল। এরপর চলে গেলাম গল ফোর্ট। ভারত মহাসাগর তীরে পর্তুগীজদের তৈরী দুর্গ।

ভারত মহাসাগর তীরে মাছের বাজার

মোটরসাইকেলে ভ্রাম্যমাণ ডাব বিক্রেতা  শত বছরের পুরনো বাণিজ্যকেন্দ্র ঐতিহাসিক দুর্গ শহর গল গল শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান শহর। কলম্বো থেকে ১১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বাংশে এ শহরের অবস্থান। দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশের প্রশাসনিক রাজধানী ও গল জেলার রাজধানী এ শহরটি। ষোড়শ শতকে পর্তুগীজরা এখানে আসে। তখন এটি জিমহাথিথ্থা নামে পরিচিত ছিল। এরপূর্বে চতুর্দশ শতকে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এ শহরটিকে ‘কালি’ নামে উল্লেখ করেছিলেন। ঐ সময় দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রধান বন্দর হিসেবে গল পরিচিতি পায়।

অষ্টাদশ শতকে এ শহরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শীর্ষস্থানে পৌঁছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পর্তুগীজদের স্থাপত্যশৈলীর উজ্জ্বল নিদর্শন ক্ষেত্র এটি। ১৬৪৯ সাল থেকে ওলন্দাজরাও এ শহরের প্রাচীরকে বিস্তৃত করেছে। গল দূর্গ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের আওতাভূক্ত এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের কর্তৃক নির্মিত এশিয়ায় বিশাল দুর্গ হিসেবে আজো সগৌরব অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে প্রাকৃতিক উপত্যকা, জাতীয় নৌ যাদুঘর, সেন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রাল, শিব মন্দির অন্যতম। ক্রিকেটের স্বর্গভূমি এ শহরটি। পৃথিবীর অন্যতম দর্শনীয় ও ছবির মতন ক্রিকেট স্টেডিয়াম হিসেবে গল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামকে বিবেচনা করা হয়। সুনামীতে এ মাঠের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। পুণনির্মাণ করে ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৭ তারিখে পুণরায় টেস্ট খেলার আয়োজন করা হয়।

 

দুর্গের বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরে দেখলাম। প্রাচীন স্থাপনা গুলো দেখতে দেখতে একটি নষ্টালজিক অনুভূতি তৈরি হলো। জাতীয় নৌ যাদুঘর এবং সেন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রাল এর ভিতরে ঘুরে দেখলাম। এরপর ভারত মহাসাগর তীরে দুর্গ প্রাচীর ধরে হেঁটে হেঁটে সাগরের বাতাস গায়ে মেখে ঘুরে দেখলাম সুবিশাল এবং সুনির্মিত দুর্গটি। সাগর পাড়ে একটি কচ্ছপের প্রজনন কেন্দ্র দেখলাম। এখানে কচ্ছপের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বড় করে তারপর সাগরে ছেড়ে দেয়া হয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কত সচেতন এরা ! এত বিশাল দুর্গ এলাকা কিন্তু কি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন! পরিত্যক্ত পলিথিন, খালি পানির বোতল কিছুই দেখলামনা। হকারের উৎপাত নেই। আমাদের চেয়ে কত সভ্য এরা! একটা ট্যুরিস্ট বান্ধব পরিবেশ তৈরি করেছে তারা। তারা জানে তাদের প্রাকৃতিক এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা ব্যবহার করে কিভাবে ট্যুরিস্ট আকর্ষন করা যায়। কোটি কোটি ডলার আয় করছে তারা পর্যটন থেকে।

মাস্ক মিউজিয়াম এ লেখক কারিগরেরা মুখোশ এবং হস্তশিল্প তৈরিতে ব্যস্ত এরপর চলে গেলাম বিশ্বখ্যাত গল ক্রিকেট ষ্টেডিয়ামে। সবুজ গালিচা বিছানো ষ্টেডিয়ামটিতে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। ষ্টেডিয়ামটির একটি অংশে দর্শকদের জন্য ঘাসের উপর বসার ব্যবস্থা আছে। এরপর গেলাম ‘মুনষ্টোন মাইন’ এ। এটি একটি বিভিন্ন মূল্যবান পাথর, রত্নের খনি এবং পাথরের জুয়েলারি তৈরির প্রতিষ্ঠান। চোখ ধাঁধানো সব পাথর এবং জুয়েলারি তেমনি পিলে চমকানো দাম। কেনার সাহস বা ইচ্ছাই হলোনা। এরপর কিছু হস্তশিল্পের দোকানে গেলাম। সেখানে দেখলাম কারিগররা বিভিন্ন জিনিস তৈরি করছে। আমরা বেশ কিছু হস্ত শিল্প কিনলাম এখান থেকে।

মাদু গঙ্গা জলাভূমিতে সাফারি এবং দারুচিনি দ্বীপে

মাদু গঙ্গা একটি জলাভূমি যা ভারত মহাসাগরে পতিত হয়েছে এবং সাড়ে ৪ কিমি এলাকা জুড়ে এর বিস্তৃতি । এই জলাভূমিতে রয়েছে পরিবেশগত, জৈবিক ও নান্দনিক তাৎপর্যের প্রায় ২৪৮ টি মেরুদন্ডী প্রাণী এবং প্রায় ৩০৩ প্রজাতির উদ্ভিদ। এই জলা ভূমির বিভিন্ন দ্বীপের অধিবাসীরা দারুচিনি এবং দারুচিনি তেল উৎপন্ন করে।

মাদুগঙ্গা জলাভূমি সাফারি শুর (বাম থেকে আমি, ধাম্মিকা ও মহিউদ্দীন স্যার। পিছনে ড্রাইভার বুদ্ধিকা) ফিস থেরাপি
সাফারির জন্য একটি ইঞ্জিন চালিত বোটে উঠে পড়লাম সবাই। আমি, মহিউদ্দিন স্যার, ধাম্মিকা এবং ড্রাইভার বুদ্ধিকা সহ আমরা চারজন। মূল বিস্তীর্ণ জলা ভূমিতে প্রবেশের পূর্বে সংকীর্ণ ম্যানগ্রোভ ঢাকা চ্যানেল পাড়ি দিতে হয়। এই চ্যানেলের মাধ্যমেই জলাভূমিটি ভারত মহাসাগরে সংযুক্ত হয়েছে। এই সংকীর্ণ চ্যানেলের কিছু কিছু জায়গার ওপর ছোট ছোট সড়ক সেতু রয়েছে যা এত নীচু যে, সেতুর নীচ দিয়ে বোট যাওয়ার সময় আমাদের মাথা নিচু করে বোটের খোলের সাথে প্রায় মিশে যেতে হয়েছিল। চ্যানেলের কিছু জায়গায় চারপাশে এমন ভাবে ম্যানগ্রোভ বন ছিল যে সে স্থান গুলোও আমাদের বোটের খোলের সাথে মিশে পার হতে হয়েছে। যাত্রাপথে এক জায়গায় নদীর এক পাশে রয়েছে ফিস স্পা আর ফিস থেরাপি। ধাম্মিকা আমাদের এখানে না নিয়ে গেলে এই অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতাম। নদীর পানিতে নেট দিয়ে তাতে এক ধরনের লাল রঙের প্রচুর মাছ রাখা হয়েছে। যারা ফিস থেরাপি নেন তারা এখানে পা ডুবিয়ে বসেন আর ঝাঁকে ঝাঁকে লাল মাছ এসে ঠুকরিয়ে পায়ের মরা চামড়া খেয়ে পরিষ্কার করে দেয়। সে এক গা কাঁটা দেয়া অবর্ণ্নীয় অভিজ্ঞতা।

এরপর এক্সাইটিং বোট রাইড শেষে পৌঁছে গেলাম বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে। প্রথমেই চলে গেলাম একটি দারুচিনি দ্বীপে। সেখানে আমাদের স্বাগত জানাল এক দারুচিনি চাষী। বড় একটি কুঁড়েঘর রয়েছে তার থাকার জন্য। ঘরের সামনে উঠান আর একটি চালা ঘর রয়েছে যেখানে সে বসে দারুচিনি প্রক্রিয়াজাত করে। আমাদের চমৎকার সুগন্ধের দারুচিনি দেয়া রঙ চা পরিবেশন করল। চালাঘরে বসে রঙ চা খেতে খেতে আমরা দেখলাম কিভাবে সে দারুচিনি প্রক্রিয়াজাত করে। আমরা তার থেকে কিছু দারুচিনি আর দারুচিনির তেল কিনলাম।

জলাভূমি জুড়ে ছড়ানো ছিটানো প্রচুর জেলে দেখলাম যারা ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে মাছ ধরছিল। এরপর গেলাম একটি দ্বীপে যেখানে ছিল বেশ বড় একটি বৌদ্ধ মন্দির। নৌকা ভিড়ানোর ঘাটেই স্থাপিত ছিল বিশালায়তন বুদ্ধ মূর্তি যেটি অনেক দূর থেকেই দৃশ্যমান। ছোট বড় বিভিন্ন আকারের বুদ্ধ মূর্তি দ্বীপটির বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ছিল। সেখানে কিছু ছবি তুলে ফিরতি পথে রওনা দিলাম। দেড় ঘন্টার চমকপ্রদ রিভার সাফারি শেষে বোট থেকে যখন ঘাটে নামলাম তার রেশ রয়ে গেল অনেক্ষন।


ম্যানগ্রোভ বনের ভিতর সাফারি ম্যানগ্রোভ বনের ভিতর সাফারি

এবার গল এক্সপ্লোরিং শেষ করে রওনা দিলাম কলম্বোর উদ্দেশ্যে। কলম্বো পৌঁছেই কলম্বোর কিছু জায়গা ঘুরবো তারপর ডিনার করে সোজা এয়ারপোর্ট। ধাম্মিকা বারবার বলছিল এত অল্প সময় নিয়ে কেন আসলাম, সে বলছিল ফ্লাইট শিডিউল চেইঞ্জ করে আরেকটা দিন থাকার জন্য। কিন্তু দেশে ফেরার জন্য আমরা উদ্গ্রীব হয়ে ছিলাম। পথে একটি রেষ্টুরেন্টে লাঞ্চ করে নিলাম সবাই। ধাম্মিকাই বিল দিল, অনেক জোরাজুরির পরও আমাকে দিতে দিলনা। কলম্বো পৌছালাম সন্ধ্যা সাতটার দিকে।
কলম্বোতে ঝটিকা কয়েক ঘন্টা।

সেই সকাল ছয়টা থেকে ড্রাইভার বুদ্ধিকা আমাদের সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হলনা সে ক্লান্ত। সবসময় মুখে একটা স্মিত হাসি লেগেই আছে। যাই হোক কলম্বোতে সত্যিকার অর্থেই কয়েক ঘন্টার ঝটিকা সফর দিলাম।
ইন্ডেপেন্ডেন্স স্কোয়ার

প্রথমেই চলে গেলাম নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর ইন্ডেপেন্ডেন্স স্কোয়ার। এটি একটি জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ যা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার স্মৃতিরক্ষার জন্য ১৯৪৯ সালে নির্মিত হয়েছে। এখানে একটি স্বাধীনতা স্মারক যাদুঘর রয়েছে। স্মৃতিসৌধের প্রধান স্থানে শ্রীলঙ্কার প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং "জাতির পিতা" ডন স্টিফেন সেনানায়েকের মূর্তি রয়েছে এবং এই কেন্দ্রটির চারপাশ জুড়ে প্রচুর ভাষ্কর্য রয়েছে। বর্তমানে এটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং বার্ষিক জাতীয় দিবস পালনের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ইন্ডেপেন্ডেন্স স্কোয়ার

বন্দরনায়েকে স্মৃতি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হল কলম্বোতে অবস্থিত একটি কনভেনশন কেন্দ্র। এটি ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের মধ্যে চীনের সহায়তায় নির্মিত। এটি শ্রীলংকার প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী সলোমন দিয়াস বন্দরনায়েকের (১৯৫৬-১৯৫৯) স্মরণে নির্মিত হয়েছে।

বন্দরনায়েকে আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সম্মুখ অংশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বাসভবন। এরপর চমকপ্রদভাবে ধাম্মিকা আমাদের নিয়ে গেল শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বাসভবনে। ধাম্মিকা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বাহিনীর সিনিয়র প্রশিক্ষক। কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় পার হয়ে কার্যালয়ের ভিতরে প্রবেশ করলাম ট্যাক্সিসহ। ধাম্মিকাকে দেখে নিরাপত্তা রক্ষীরা সসম্মানে ছেড়ে দিল তবে সে আমাদের পরিচয় সম্মন্ধে তাদের জানাল। ভিতরে গাড়ি থেকে নামলামনা, ছবিও তুললামনা, এটি হাই সিকিউরিটি এরিয়া। ভেতরটা গাড়িতে করে একটি চক্কর দিয়ে বের হয়ে আসলাম।

কলম্বো টাউন হল এটি কলম্বো মিনিসিপ্যাল কর্পরেশনের সদর দফতর এবং মেয়রের কার্যালয় ও বাসভবন। চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর ভবনটি ১৯২৪ সালে নির্মিত এবং ঐতিহ্য সংরক্ষনে সচেতন কর্তৃপক্ষ যথাসম্ভব ভবনটির সবকিছু অপরিবর্তনীয় রেখে দিয়েছে।

কলম্বো টাউন হল, সীমা মালকা ভাসমান মন্দির

সীমা মালকা কলম্বোর বিইরা লেক এ অবস্থিত একটি বৌদ্ধ মন্দির। এটি পূজা করার চেয়ে প্রধানত ধ্যান এবং বিশ্রাম এর জন্য ব্যবহার করা হয়। মন্দিরটি ১৯ শতকের শেষের দিকে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি পুনর্নির্মাণে অর্থায়ন করেছিলেন শ্রীলংকার মুসলিম ব্যবসায়ী, এস এইচ মোসাজি এবং তার স্ত্রী, তাদের পুত্র আমির এস মূসাজির স্মরণে। মন্দিরটি বিইরা লেকের মাঝখানে অবস্থিত এবং এই মন্দিরটি তিনটি প্ল্যাটফর্মের উপর নির্মিত, যা মূল ভূখণ্ডের সাথে পন্টুন ব্রিজ দ্বারা সংযুক্ত। মন্দিরের স্থাপত্য কান্দিয়ান যুগের মত, তিনটি প্ল্যাটফর্মে বুদ্ধের বিভিন্ন মুদ্রা প্রদর্শনের অসংখ্য মূর্তি আছে।

সীমা মালকা ভাসমান বৌদ্ধ মন্দির সীমা মালকা ভাসমান বৌদ্ধ মন্দির
এরপর একটি সুপারশপ এবং হ্যান্ডিক্রাফটস শপে গিয়ে কিছু কেনা কাটা সেরে নিলাম। সুপার শপের একটি জিনিষ চোখে পড়ল, তা হল এদের অন্যতম রপ্তানী এবং

অর্থকরী পণ্য চা এবং কফির সমাহার। হরেক ব্রান্ডের, আকারের, নানা প্যাকের নানা ফ্লেভারের চা এবং কফি সাজানো বড় অংশ জুড়ে। আমি মূলতঃ চা কফিই কিনলাম। এরপর রয়েছে হারবাল বিভিন্ন ঔষধ এবং প্রসাধন পণ্যের সমাহার। এসবের জন্য সুপার শপের বেশ অনেকখানি জায়গা বরাদ্দ ছিল। আর হ্যান্ডিক্রাফটস শপের বেশির ভাগ জিনিষ নারকেলের খোল আর ছোবড়া দিয়ে তৈরী।

এরপর ডিনারের জন্য ধাম্মিকাকে বললাম এমন একটি রেষ্টুরেন্টে নিতে যেটির সী ফিশের জন্য সুনাম রয়েছে। কয়েকপদের সামুদ্রিক মাছ দিয়ে চমৎকার উপাদেয় একটি ডিনার সারার পর ঘড়িতে দেখি রাত ১২ টা পার হয়ে গেছে। ক্যালেন্ডারের তারিখ পালটে হল ১০ নভেম্বর ২০১৭। এবারও ধাম্মিকা ডিনারের বিল দেয়ার পাঁয়তারা করছিল কিন্তু এবার আগেই প্রস্তুত ছিলাম, কোনোভাবেই তাকে দিতে দিলামনা।

সামুদ্রিক মাছের কারি দিয়ে ডিনার ডিম দিয়ে তৈরি পিঠা

বিদায়ের সুর বেজে উঠল। বন্দরনায়েকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পথিমধ্যে ধাম্মিকা নেমে গেল যেখান থেকে তাঁর বাসা কাছে। তাকে  হাগ করে আন্তরিক বিদায় সম্ভাষণ জানালাম, ধন্যবাদ জানালাম সারাদিন সময় দেয়ার জন্য এবং আমাদের ভ্রমণের সবকিছু ব্যবস্থা করে রাখার জন্য। প্রিয় একজন মানুষ থেকে বিদায় নিলে যেমন অনুভূতি হয় আমিও তেমনি অনুভব করছিলাম।

বিদায় শ্রীলঙ্কা! বন্দরনায়েকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অপেক্ষা ঢাকার ফ্লাইটের জন্য রাত একটায় গিয়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছালাম। ঢাকার ফ্লাইটের চেক ইন ভোর ৬টায়। এই কয়েকঘন্টা এয়ারপোর্টে বসে নেট ব্রাউজ করে কাটিয়ে দিলাম। ঘুমহীন দ্বিতীয় রাত্রি অতিবাহিত করলাম রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে। ১০ নভেম্বর সকাল ১০টায় পা রাখলাম ঢাকায়। কি আশ্চর্য! পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তি বিদায় নিল! দেশের মাটি বলে কথা!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়