ড. এম এ মাননান : দেশ বদলের কথা যতই বলি, দেশ বদল এমনিতে হয় না। দেশ বদল একটি অনেক বড় ব্যাপার। এটি করতে হলে আগে ছোট্ট একটি বদলের দরকার যা আমরা বদলের প্রত্যাশীরা ভেবেই হয়তো দেখি না। তা হলো, নিজকে বদলানো। কতজন আমরা নিজকে বদলাতে পেরেছি? যদি বলি, বদলিয়েছি তো, তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বলতে হবে বদলানো হযেছে শুধু খোলস, অন্তর নয়। দরকার অন্তরের বদল, অন্তরের ইতিবাচক বদল। টোটাল প্যারাডাইম শিফ্ট। দিলের গহীনে লুকিয়ে থাকা নেতিবাচক ডার্টিম্যানটাকে ওখানে থাকতে দিয়ে আমরা তো নিজকেই বদলাতে পারব না; দিন বদল কিংবা দেশ বদলানো তো বহু দূরের কথা। রাস্তায় নেমে কিশোররা দেখিয়ে দিয়েছে বড়রা কতটা দায়িত্বহীন আর দেশপ্রেম-বর্জিত। ন্যূনতম দায়িত্বও যদি তারা পালন করত, দিয়া-সজীবের সবুজ জীবনটা মেটো হয়ে যেত না; ওদেরও আতঙ্কিত মনে রাস্তায় নেমে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ বা ‘যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ’ শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় গর্জন তুলতে হতো না। বড়রা কি ভুলে গিয়েছে যে, আজকের এ কোমলমতিরাই কালকের ভোটার, জনপ্রতিনিধি-নির্বাচক, আগামীর নীতিনির্ধারক, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কারিগর, আমাদের আলোর মশাল বাহক।
কিশোর শিক্ষার্থীরা যেভাবে রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে দেখিয়ে দিয়েছে, সেভাবে কর্তাব্যক্তিরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করলে সমস্যাটা কোথায়? কিন্তু সেভাবে তো দূরের কথা, আবার আগের অবস্থাতেই তারা চলে গিয়েছে। বিগত কয়েক দিন দরে ঢাকা-গাজীপুরের সড়কে যে ট্রাফিক নৈরাজ্য চোখে পড়েছে তা শিক্ষার্থী-আন্দোলনের আগের দিনগুলাকেও হার মানাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের দেখানো পন্থাগুলো যদি অগ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে কর্মকর্তারা বলে দিক না, অগ্রহণযোগ্যতার কারণগুলো কী কী? জনসাধারণ যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষার্থীদের সমর্থন দিয়েছিলো তারা একটু হলেও শান্তনা পাবে। আর যদি কোন যুক্তি না থাকে তাহলে যারা আবার সড়কে নৈরাজ্য সৃষ্টির সুযোগ করে দিচ্ছে তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনা অত্যাবশ্যক। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদেরকে লালনপালন করা হয়, এ কথা ভুলে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
সড়কের নৈরাজ্য দূর করার জন্য হাত দিতে হবে মূলে। শেকড় ধরে টান না দিলে সমস্যার কোন সুরাহাই হবে না। আর শেকড়টি নিহিত রয়েছে ওইসব সরকারি সংস্থায় যেগুলোর দায়িত্ব হলো সঠিক ব্যক্তিকে গাড়ি চালনার লাইসেন্স দেওয়া, অন্তত প্রতি তিন বছর পর পর লাইসেন্সধারীদের শারীরিক যোগ্যতা পরীক্ষা করে লাইসেন্স নবায়ন করা, যানবাহন সঠিকভাবে পরীক্ষা করে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া, লাইসেন্স ইস্যু আর নবায়নের সময় সংশ্লিষ্টদের হয়রানি-ভোগান্তি না-হওয়া নিশ্চিত করা, সময়-ক্ষেপন না করা, নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি পার্কিংসহ ওঠানামা নিশ্চিত করা, নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্যত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করালে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা, সকল সড়ক সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা এবং চেহারা শনাক্তকরণ ডিভাইসের মাধ্যমে অপরাধী-চালকের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা (এ কাজটি চীন, নিউজিল্যান্ড এবং আরব আমিরাতে খুব সাফল্যের সঙ্গে করা হয়েছে), সিগনাল মানা বাধ্যতামূলক করা (অমান্যকারীদের সঙ্গে সঙ্গে জরিমানাসহ লাইসেন্স বাতিলের ব্যবস্থা করা), সড়কগুলোকে চলাচলের উপযোগী করে রাখা (চালক যতই ভালো প্রশিক্ষিত হোক না কেন, রাস্তা এবড়ো-থেবড়ো ভাঙ্গাচোরা হলে দুর্ঘটনা ঘটবেই), জেব্রা ক্রসিং ছাড়া পথচারীদের রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা রোধের ব্যবস্থা নেওয়া (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরের মতো ট্রাফিক আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যারা রাস্তা পার হয় তাদেরকে অন্ দ্য স্পট জরিমানা করে তা আদায় করা (অন্যথায় পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা), এসব ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কোনো সদস্য অন্যায়-অনিয়ম করলে তার কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি, আইন মান্য করে চলার সংস্কৃতি তৈরি করা।
শুধু আইন দিয়েই যে সড়ক নিরাপদ করা যায় না, নৈরাজ্য ঠেকানো যায় না কিংবা দুর্ঘটনা রোধ করা যায় না, তা শিল্পোন্নত দেশগুলোতেও প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক কতকগুলো বিষয়ও নিশ্চিত করতে হবে। আইন মান্য করার সংস্কৃতি সৃষ্টির কাজটি শুরু করতে হবে প্রত্যেকের আপন আলয়ে। বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন সবাই নিজেরা আইন মেনে শিশুদের মনে এ প্রত্যয় তৈরি করতে হবে যে আইন-কানুন মানাটা সামাজিক শৃঙ্খলারই অংশ। স্কুলে প্রাথমিক পর্যায়েই ট্রাফিক আইন ও নিয়মকানুন শেখাতে হবে হাতে কলমে। শ্রীলঙ্কায় কয়েক বছর আগে প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটি গবেষণার কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, শিশুদেরকে স্কুলের সামনের রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের কাজ করতে দেওয়া হয় প্রত্যেককে পালাক্রমে প্রত্যেক সপ্তাহে। একজন শিক্ষক তাদেরকে গাইড করেন। ফলে শিশুরা অল্প বয়সেই ট্রাফিক ব্যবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করে। পরবর্তী জীবনে তারা ট্রাফিক আইন মান্য করার কালচারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
বড়রা রাস্তায় যেভাবে চলাফেরা করে, শিশুরা তা অনুসরণ করে। সেজন্য বড়দেরকে অবশ্যই সড়কে চলাচলের নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে যাতে তাদেরকে দেখে ছোটরা স্বাভাবিকভাবেই নিয়মগুলো আয়ত্ত করে নেয়। বাংলাদেশের শহরের রাস্তাগুলোতে বড়রাই ট্রাফিক আইন-কানুন লঙ্ঘণ করে বেশি।
গাড়ির মালিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাদের স্বার্থেই প্রশিক্ষিত বৈধ লাইসেন্সধারী চালক নিয়োগ দিতে হবে। চালক নিয়োগ করার সময় মালিক বিআরটিএ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত চালক-ডাটাবেজ ব্রাউজিং করে দেখবেন প্রার্থী-চালকের বৈধ লাইসেন্স আছে কিনা (কোনো মালিক বৈধ লাইসেন্সধারী চালক নিয়োগ না দিলে তাকে আইনের আওতায় অবশ্যই আনতে হবে)। চালকদেরকে প্রতি দুই বছর পর পর রিফ্রেসার ট্রেনিংয়ে পাঠানো উচিত যাতে তারা গাড়ির সর্বশেষ টেকনোলজিক্যাল বিষয়গুলো জেনে নিতে পারে। এ ব্যাপারে স্থানীয় বিআরটিসির ট্রেনিং ইউনিটের সাহায্য নিতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, উ›মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক গাড়ি-চালককে বিআরটিসিতে নিয়মিত রিফ্রেসার ট্রেনিংএ পাঠানোর ফলে এদের কর্মদক্ষতা বহুগুণে বেড়েছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, চালকরা এ দেশেরই সন্তান; তারা আমাদের মূল্যবান সম্পদ। এদেরকে উত্তম শিক্ষা দেওয়া হলে তা হবে দেশের জন্য উত্তম বিনিয়োগ।
সড়ক পরিবহনে যেসব সিন্ডিকেট নৈরাজ্য সৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রাখে সেগুলোকে আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই দুমড়েমুচড়ে ভেঙ্গে ফেলতে হবে, দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট; উপাচার্য, বাংলাদেশ উ›মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন :