শিরোনাম
◈ গাজীপুরে হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু  ◈ বিশৃঙ্খলার পথ এড়াতে শিশুদের মধ্যে খেলাধুলার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে: প্রধানমন্ত্রী ◈ তাপপ্রবাহের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা ◈ সোনার দাম কমেছে ভরিতে ৮৪০ টাকা ◈ ঈদযাত্রায় ৪১৯ দুর্ঘটনায় নিহত ৪৩৮: যাত্রী কল্যাণ সমিতি ◈ অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধে বিটিআরসিতে তালিকা পাঠানো হচ্ছে: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ◈ পাবনায় হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি ◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সেই সম্পত্তি দিয়ে দেবো (ভিডিও)

প্রকাশিত : ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ০৮:২৬ সকাল
আপডেট : ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ০৮:২৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম শতবার্ষিকী

সোহেল অমিতাভ : গতরাতে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাসা থেকে আমাকে সাদ্দার স্ট্রিটের হোটেলে নামিয়ে সুভাষ একই ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। রাত অনেক হওয়ায় তাঁকে আর হোটেলে ঢুকতে বলিনি। যাবার সময় তিনি তাঁর বাসার ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছিলেন আর বলেছিলেন সকালে এসে আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যাবেন। হয়তো কোন এক সাহিত্য সভায়।

আমি ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে বসে বসে ভাবছি কোলকাতা এসে আমার প্রথম ও একমাত্র উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কিন্তু এ কোন শক্তি! যার কবিতার রহস্যময়তা আমাকে টেনে হিঁচড়ে এই কোলকাতায় হাজির করেছে সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কোন আলোক ছটাই তো চোখে পড়লো না। এই কি সেই কবি, যার দর্শন প্রাপ্তিতে পাগল হয়ে আছি! কবিতার চিত্রকল্প আর কবির বাস্তবতার সঙ্গে তাহলে কি এত ফারাক! শক্তিকে অমন জড় পদার্থের মতো ¤্রয়িমান দেখলাম কেন, কি হয়েছে তাঁর?

ঘড়িতে প্রায় দশটা বেজে গেলো, ভাবলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে একটা ফোন করি। কোলকাতার টেলিফোনের রিংটোনটা কেমন একটু পরখ করি। তা ছাড়া রাতে মাল খেয়ে ঐ বুড়োটার আজকের কথা মনে থাকবে তো! তাঁর দেয়া নাম্বারে ফোন করে কোলকাতার রিংটোন শুনছি, অনেকক্ষণ ধরে। ধৈর্য্য যখন দিশেহারা, ফোনের প্রান্ত থেকে এক নারীকণ্ঠ ভেসে এলো। দূরালপনীতে কোলকাতার প্রথম নারীকণ্ঠ।

: হ্যালো, কে বলচেন?

: আমি সোহেল, সোহেল অমিতাভ বলছি...

: এই সুভাষ, তোমার সেই সোহেল না কে যেন ফোন করেচে ।

রিসিভার হাতে রেখেই নারীকণ্ঠ সুভাষকে আমার সংবাদ দিয়ে আবার ফিরলেন আমার সঙ্গে।

: সুভাষ রেডি হচ্চে, আপনাকে অপেক্ষা করতে বলেচেন।

বেহায়ার মত জানতে চাইলাম, আপনি কে বলছেন? আমার না দেখা তাঁর হাসিটার অডিও উত্তাপ এসে আমার কানে বাজলো, গীতা...

তারপর ফোনটা কেটে গেলো।

বুড়োর দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় মিললো। ভাবলাম আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন তিনি; নিশ্চয় কোন মেঠোপথে জলাভূমি পেরিয়ে সাহিত্যকীটদের সস্তা-সমাবেশে নাকি কোন সাহিত্যরতœদের পাথর প্রদর্শনীতে! যেখানেই হোক তিনি যে আমাকে বাজিয়ে দেখবেন এটা নিশ্চিত ভেবে একটা ঠা-া বিয়ারের পিপাসা পেলো। এ হোটেলে কোন বার নেই, তাই রুম থেকে বেরিয়ে হোটেলের সদর দরজায় নেমে এলাম। গতরাতে যে নাইট গার্ডকে মোটা বকশিস দিয়েছিলাম, সে এগিয়ে এলো, সেলাম বাবু বলে আমার কাছে জানতে চাইলো আমার কিছু লাগবে কি না? আমি বললাম, তোমাকে না রাতে ডিউটি করতে দেখলাম, এখনো ডিউটি করছো, বাসায় যাওনি? লোকটা হেসে গলে পড়লো, বললো বাসা কি আর বাড়ির কাছে! জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় তোমার বাড়ি ? পাটনা বাবু, বিহারের পাটনা। আঁতকে উঠলাম, শালা বিহারীর খপ্পরে পরলাম না কি? ‘৭১ এর পর থেকে বিহারী সম্পর্কে আমার ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা ছিল, সেটাইতো স্বাভাবিক। আমি আনমনা হচ্ছি দেখে লোকটা এবার জিজ্ঞেস করলো, বাবু কিছু লাগবে? বললাম, না। আর একটু ভাব নিয়ে বললাম ঠা-া বিয়ার খেতে যাচ্ছি, গ্র্যান্ড ওবেরয় ছাড়া কাছে-পিঠে কোন বার নেই? এখনো তো বার খোলেনি, আমি এনে দেই বাবু, ঠা-া বিয়ার? আবার আবদার করলো লোকটা। কটা বিয়ার লাগবে শুনতে চেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। উপায় অন্তর না পেয়ে বললাম, যাও ৪টা বিয়ার নিয়ে আসো। একটা বড় নোট ধরিয়ে দিলাম, যেহেতু দাম জানিনা; জিজ্ঞাসাও করলাম না। লোকটা টাকাটা লুফে নিয়ে উধাও হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম না কোন দিকে গেলে ঠা-া বিয়ার এই অসময়ে আমিও জোগাড় করতে পারি।

হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে পায়চারী করছি আর নোংরা কোলকাতাকে দেখে দুঃখ পাচ্ছি। এমন সময় চুলছাঁটা মাথা নিয়ে আরো নোংরা পোশাকে এক হ্যাংলা-পাতলা যুবক আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। প্রথমে তাকে ভিক্ষুক অথবা অপ্রকৃতস্ত ভেবেছিলাম। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো স্যার, চরস লাগবে? ভালো চরস আছে, নেপালি চরস। বুঝতে বাকি রইলনা যে, সে একটা নেশাখোর এবং নেশা বিক্রেতা। তার প্রস্তাবে আমার জিহ্বায় যেন জল গড়িয়ে পড়লো। বললাম কই দেখি, প্যান্টের পকেট থেকে চরসের দলাটা বের করে আমার সামনে দৃশ্যমান করলো। দাম চুকিয়ে দিতেই সে কোথায় যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ততক্ষণে আমার হোটেলের দারোয়ান হাজির। আমাকে একঝোলা ঠা-া বিয়ার ও বাঁকি পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, বাবু ওসব খুব খারাব আদমি, মাত বাত করিয়ে বাবু, বহুত খারাপ আদমি হ্যাঁয় ছালা। আমিও উর্দু বলার ভঙ্গিতে বললাম, হাম জানতা হ্যাঁয়। তাকে বকশিস দিয়ে মুখবন্ধ করতে চাইলাম, তবুও পিছু ছাড়লো না। হোটেলের বয় ডেকে আমার রুমের গ্লাস পরিষ্কার করে দিতে বললো। বুঝলাম এই প্রবীণ কর্মচারী মালিকের খুব বিশ্বস্ত। হোটেলের আনাচে-কানাচে কোথাও হয়তো বসবাস করে। তবে আমি যে ওর চোখের আড়ালে ‘চরস’ কিনে ফেলেছি সেটা ও বুঝতে পারেনি। হোটেল বয় অহেতুক পরিষ্কার গ্লাস আবার ধুয়ে মুছে দিয়ে একটা কর্ক ওপেনার রেখে গেলো। বকশিস দিয়ে বিদায় করে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

পাঁচ বেডের বিশাল ঘর এটা। বিশাল বিশাল জানালা, ছাদ থেকে লম্বা লম্বা পাইপের মাথায় ফ্যানগুলো ঝুলছে। একটা জানালা বেশ কষ্ট করে খুলে দিলাম। মনে হলো ‘৪৭ সালের পর এই প্রথম এটা খোলা হলো। জানালা দিয়ে অন্য ঘরবাড়ি আর ড্রেনের উগরানো সুগন্ধি ঢুকে পড়লো! বাহ এমনটাই তো চাচ্ছিলাম। পকেট থেকে দ্রুত চরসের দলাটা বের করে সিগারেটের তামাকে মেশানোর আগে দেশলাইয়ের আগুনে পুড়িয়ে নিলাম। তারপর মেশাতে মেশাতে বুঝতে পারলাম জিনিসটার কোয়ালিটি ভালো। এরপর যখন চরস টানা শুরু করেছি এবং বিয়ারের বোতল খুলবো তখনই রিসিপশন থেকে ফোন এলো। সুভাষ মুখার্জী এসেছেন। আমি তাকে রুম পর্যন্ত পৌঁছে দেবার অনুরোধ করে ফোন রেখে দিলাম। খোলা জানালার ধারে এসে মনের সুখে চরসে টান দিতে লাগলাম। কতদিন পড়ে দেখা হলো এই বস্তুর। সুভাষ আর একটু দেরী করতে পারলোনা!

‘৭৫ এর ধানমন্ডি হত্যাযজ্ঞের পরে বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে ড্রাগ আসক্তি করার একটা নীল নকশা হাতে নিয়েছিলো ‘৭১ এর পরাজিত পক্ষ। বহু নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় আজিজ মোহাম্মাদ ভাই নামে এক বিখ্যাত আগাখানী পাকিস্তান থেকে জন্মদিনের কেকের মধ্যে চরস ঢুকিয়ে এয়ারপোর্ট দিয়ে নিয়ে আসতো। বনি নামে তার এক ভাগ্নের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চরসের চালান চলে আসতো। শহীদ অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর সন্তান আশফাক মুনির মিশুক সহ প্রায় সকল হতাশাগ্রস্থ প্রতিভাবানেরা এই চরসে আসক্ত হয়ে পড়ে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মফস্বলের কালিমা ধুয়ে আপগ্রেডেড হওয়ার জন্য প্রথমে সিগারেট তারপর অল্প কিছুদিন গাঁজা এবং ফাইনাল রাউন্ডে চরস ভুবনে আকৃষ্ট হই। আমাদের ক্যাম্পাসে চরস জনপ্রিয় হলে চট্টগ্রাম বন্দরে বিশাল এক চরসের চালান ধরা পড়ে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেই চরসের চালানে আগুন ধরিয়ে সাফল্যের বিরাট এক মিডিয়া কাম্পেইন সম্পন্ন করে। আর চরস ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। গাঁজাখোরদের এক গ্রেড উন্নতি সম্পন্ন হয়। মূলত আগুন ধরিয়ে চরস পোড়ানো হয়নি, পোড়ানো হয়েছিল কিছু গার্বেজ কাগজপত্র। মূল চরসের চালান কারবারিদের হাতেই ফিরে যায়। চরসের পর ঢোকানো হয়েছিল হেরোইন আর ফেনসিডিল। ভাগ্যিস আমি তখন দেশান্তর! কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম শতবার্ষিকীতে দেখছি মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-িত সাজাপ্রাপ্ত আসামী মীর কাশেম আলীর বার্মিজ উপহার, ‘ইয়াবা’র রামরাজত্ব চলছে বাংলাদেশে!

দরজায় নক পড়তেই খুলে দিলাম। সুভাষ’কে ঘরে ঢুকিয়ে ক্ষমা চাইলাম, রিসিপশনে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা না করায়। তিনি সে কথায় কান না দিয়ে ঘরটার আকাশ পাতাল তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। খোলা জানালাটায় এসে মুখ বের করে এদিক সেদিক দেখলেন। ভয় পেলাম চরসের গন্ধ বুঝে ফেললো নাকি বুড়োটা। সুভাষ বললেন, সোহেল জানালাটা বন্ধ করে দাও, এটা থেকে ড্রেনের ময়লা গন্ধ ঢুকবে। আমি জানালা বন্ধ করে তাকে বসতে বললাম। তিনি আসন গ্রহণের পর বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনার দেরী দেখে একটু বিয়ার খাবো ভাবছিলাম, এইমাত্র খুলেছি যদি অনুমতি দেন। সুভাষের সম্মতিতে বিয়ারের ফেনায় ভরে উঠলো দুটো গ্লাস। চিয়ার্স! গ্লাসের ধাক্কায় ঝঙ্কার তুলে শুরু হলো আমার আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অথ-কথপকথনের দিনলিপি ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়