ডেস্ক রিপোর্ট : সংঘাত শুরুর সময় পরিস্থিতি কিন্তু এমন ছিল না। সবাই মানবতার পাশাপাশি ধর্মীয় মিল থাকার কারণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নিশ্চিন্তে। নানাভাবে কক্সবাজারবাসী বরণ করে নিয়েছিলেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নির্যাতিত হয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের। কিন্তু এখন আর সেই সহানুভূতি ‘নেই’ বললেই চলে। রোহিঙ্গাদের কারণে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হওয়া, কাজের অভাব দেখা দেওয়াসহ নানা সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
সেখানে নাফ নদীর ধারে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশেই বিশাল চরের মতো। ওপারে দেখা যায় মিয়ানমারের পাহাড়। এদিক দিয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
টেকনাফের মৌসুনী এলাকার নয়াপাড়া আদর্শ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. খলিলুর রহমান জানান, এই স্কুলে বহু রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। যার প্রভাব স্কুলের পড়াশোনায় এখনো রয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি স্কুলে দ্বিতীয় সাময়িকী পরীক্ষা নিতে পারিনি। স্কুলের শিক্ষকদের বাড়তি পরিশ্রম করিয়ে তা পরে কভার করেছি।’
খলিলুর রহমানের মতে, রোহিঙ্গারা মোটামুটি প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠলেও স্কুলে তাদের উপস্থিতির একটি প্রভাব রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্কুলে দুটো পানির মটর আছে। সেখান থেকে তারা পানি নিতে আসে। তাদের স্কুলে অবাধে বিচরণ। এতে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।’
আবাদ উপযোগী অনেক জমির মাঝে খুপরি ঘর করে বসবাস করছেন রোহিঙ্গারা। যার কারণে স্থানীয়রা জমিতে কৃষিকাজ করতে পারছেন না। আবার জেলেরা মাছ ধরতে পারছেন না নদী থেকে। এ বিষয়ে মৌসুনীপাড়ার কামাল হোসেন বলেন, ‘কোস্ট গার্ড মাছ ধরতে দেয় না। এখন দিন চলে দিন মজুরি করে। কোনো দিন কাজ পাই, কোনো দিন পাই না।’
কামাল জানান, জেলেদের মাছধরা নৌকায় করে রোহিঙ্গাদের পারাপার বন্ধে এখানে জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়েছে অন্তত ১০ মাস ধরে।
সরকারি হিসেবে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে মোট ৩০টি রেজিস্টার্ড ক্যাম্প রয়েছে। কিন্তু উখিয়া ও টেকনাফের মূল সড়কগুলো ধরে গাড়ি চালিয়ে গেলে দেখা যাবে বন বিভাগের জমি, সরকারি খাস জমি ও সাধারণ মানুষজনের জায়গায় ও পাহাড়ের গায়ে রোহিঙ্গাদের আরও অসংখ্য খুপরি ঘর। বহু পাহাড়ে কোনো গাছ নেই। শুধু ছোট ছোট কুঁড়েঘরের চাল দেখা যায়। বিশাল অঞ্চলজুড়ে বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে।
তেলিপাড়া গ্রামের এক গৃহস্থ পরিবারের আমিনা বেগম বলেন, ‘ওইখানে... ওই যে, জমিতে এক বছর হলো চাষ করতে পারছি না। সেখানে রোহিঙ্গারা বাস করছে তাই। এই এক বছরে দুইবার ধান লাগাতে পারতাম।’
এই অভিজ্ঞতা এখানে বহু মানুষের। বেশ কটি মৌসুম পার হয়ে গেছে। বহু কৃষকের চাষ বন্ধ।
টেকনাফ ও উখিয়ায় বহু জনের কাছ থেকে প্রচুর গবাদি পশু চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তেলিপাড়ার রোজিনা আক্তার বলেন, ‘আমরা গরু-ছাগল, হাস-মুরগি কিছুই পালতে পারছি না। এই যে বাড়িটা, এখান থেকে একটা গরু নিয়ে গেছে। আমার বাড়ি থেকে দুটো ছাগল আর ওই যে বাড়িটা ওখান থেকে তিনটা ছাগল নিয়ে গেছে। মাঠে বাধা ছিল। দিনে দুপুরে নিয়ে গেছে।’
আমিনা বেগম ও রোজিনা আক্তারের বাড়ির উঠানেই রোহিঙ্গাদের কয়েকটি ঘর। এই গ্রামটিতে এসে মনে হলো স্থানীয়রা যেন উল্টো কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের কারণে সংকট দেখা দিয়েছে দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রেও। দিনমজুরের কাজ করেন নুরুল আলম, কিন্তু তিনি এখন আর সেভাবে কাজ পাচ্ছেন না। নুরুল আলম বলেন, ‘আমরা চার-পাঁচশো টাকায় কাজ করতাম। এখন বর্মাইয়ারা দুই-তিনশো টাকায় কাজ করে। তাই আমরা মাসে ১০ দিনের বেশি কাজ পাই না।’
রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে কক্সবাজারে কাজ করছে অনেক সাহায্য সংস্থা। তাদের গাড়ির কারণে সড়কে যানজট এখন নিত্যদিনকার ঘটনা। আবার বড় বড় ট্রাকের ভয়ে শিশুরা স্কুলে যেতে ভয় পায়।
সব কিছু মিলিয়ে মানবিক কারণে একসময় রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দেওয়া মানুষজন রোহিঙ্গাদের প্রতি যেন সহানুভূতি হারিয়ে ফেলছেন। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন মেম্বার মোহাম্মদ আলীর মতো এ রকমই। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও আমার জায়গায় তাদের থাকতে দিয়েছিলাম। মানবিক কারণে তাদের সহযোগিতা করছি। কিন্তু বর্তমানে তাদের প্রতি সেই সহানুভূতি আর নেই।’
রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। রোহিঙ্গারা সাহায্য সহযোগিতা পেলেও স্থানীয়দের জন্য দৃশ্যমান কোনো কিছু এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। পালংখালীর প্যানেল চেয়ারম্যান নুরুল আবছার চৌধুরী আক্ষেপ করে সে কথা মনে করিয়ে দিলেন। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের তো বিভিন্ন এনজিওরা সহায়তা দিচ্ছে। বাঁচতে হলে আমাদের যে অধিকার, রোহিঙ্গারা আসার কারণে তাতে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটেছে। কিন্তু আমাদের তো এরকম কোনো সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা, প্রিয়.কম
আপনার মতামত লিখুন :