আরিফুর রহমান তুহিন : ভয়াবহ ধ্বস নেমেছে চামড়ার বাজারে। ত্রিশ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে সর্বনিম্ন দামে বিক্রি হয়েছে কাঁচা চামড়া। রাজধানী কিংবা প্রান্তিক অঞ্চল, সবখানেই একই অবস্থা। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়িরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এহেন দরপতনে পাঁচারের আতঙ্কেও রয়েছে অনেকে। তবে ট্যানারি মালিক সমিতি বলছে বিশ্ববাজারে চামড়ার মূল্য হ্রাসের কারণেও কিছুটা প্রভাব পড়েছে কাঁচা চামড়ার বাজারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে চামড়ার মূল্য হ্রাস পাবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিকে সাভারে স্থানান্তর করা হলেও বিভিন্ন জটিলতায় সেখানে এখনও সকল কারখানা উৎপাদনে যেতে পারেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের উৎপাদন ক্ষমতা কমেছে। এর ফলে মালিকরা বেশি ঝুকি নিতে চায়নি। এছাড়া এই খাতে পর্যাপ্ত ঋণের অভাব রয়েছে। ফলে ব্যবসায়িদের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে। আবার বাংলাদেশের চামড়া শিল্প নিয়ে বিদেশিদের কাছে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তাই অনেকেই এদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এর ফলে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি নিয়েও ব্যবসায়িদের মনে শঙ্কা রয়েছে। বিশ্ববাজারে চামড়ার কিছুটা দরপতনও হয়েছে। এছাড়া আরেকটি অন্যতম কারণ হলো কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করণের আগে লবন দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। সেই লবনেরও দাম কিছুটা বেশি। সব মিলিয়ে প্রভাব পরেছে এবারের বাজারে। তবে এমন অস্বাভাবিক দরপতনে হতবাক সবাই।
বাংলাদেশ ভোক্তা সমিতির সভাপতি ড. গোলাম রহমান আমাদের সময় ডটকমকে জানান, বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম কমলেও এতটা কমেনি যে ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ম দাম হবে। মূলত সাভারে সকল ট্যানারি উৎপাদনে না যাওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা কমেছে। এছাড়া বিগত দুই তিন বছরে এই খাতে ব্যাংক ঋণও আশানুরুপ না। ফলে হাজারীবাগ থেকে সাভারে চলে যাওয়ার পর ট্যানারি মালিকরা আর্থিক সঙ্কটে পরেছে। এর ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
গোলাম রহমান জানান, সরকারের এখন খোঁজ নেয়া উচিত প্রতিবেশি ভারতের বাজারের কি অবস্থা। সেখানে যদি বাংলাদেশের থেকে মূল্য বেশি হয়ে থাকে তাহলে চামড়া পাচার হবে। ফলে দেশের অর্থনীতি বড় ধরণের ক্ষতির মধ্যে পরতে পারে। তাই সিমান্তে রেড অ্যলার্ট জাড়ি করার আহ্বান জানান তিনি।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, একটি উন্নতমানের ২০ থেকে ২৫ বর্গফুটের বড় সাইজের চামড়া খুচড়া ব্যবসায়িরা কিনছেন ৫’শো থেকে সাড়ে ৫ শো টাকা মূল্যে। অথচ গত বছর একই সাইজের চামড়া ফরিয়ারা কিনছেন হাজার টাকার উপরে। আর প্রান্তিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই একই ধরণের চামড়া কেউ কেউ কিনছেন চারশো টাকা দামে। অথচ ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে এর আনুমানিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো প্রায় দেড় হাজার টাকা। তাহলে কেন এত দরপতন এর কোনো সদোত্তর দিতে পারেনি এই খাতের সংশ্লিষ্ট কেউ।
বাংলাদেশ ট্যানারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্যাহ জানান, বিশ্ববাজারে বর্তমানে চামড়ার মূল্য অনেক কমেছে। এছাড়া অনেক বিদেশি ক্রেতাও বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যার প্রভাব কাঁচা চামড়ার বাজারে পড়েছে।
চামড়ার এমন দরপতনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ ছিল জনমনেও। রাজধানীর উত্তরার ইসমাঈল আহসান আমাদের সময় ডটকমকে জানান, গত বছর তিনি যেই চামড়া ৯০০ টাকা বিক্রি করেছেন এবার প্রায় একই আকারের চামড়া তিনি বিক্রি করেছেন মাত্র ৪৩০ টাকা মূল্যে। এটাকে একটি বড় ধরণের সিন্ডিকেট বলে মনে করছেন তিনি। তার মতে, ট্যানারি সালিকরা যতই বলার চেষ্টা করুক যে, বিশ্ববজারের দরপতনের কারণে এমন অবস্থা সেটা গ্রহণযোগ্য না। মূলত অতিরিক্ত মুনফার লোভে তারা এই কাজ করছেন। এতে প্রতিবেশি দেশগুলোতে চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তালহা যুবায়ের সজিব নামের এক প্রকৌশলি জানান, তার ১ লাখ টাকা মূল্যের কোরবানির গরুর চামড়ার দাম বলছে মাত্র ৪শো টাকা। ক্ষোভে তিনি সেটি মাটিতে পুতে রেখেছেন। আর চামড়ার যে দাম পাইকাররা বলেছিলেন সেই পরিমান মূল্য একটি এতিমখানায় দান করে দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্যানারি মালিক জানান, তারা কাঁচা চামড়ার যেই দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিলো সংগ্রহকারিরা সিন্ডিকেট করে সেই দাম অনেক কমিয়েছে। চামড়ার দাম কমানোর জন্য তারা বাজারে নেতিবাচক প্রচারণা করেছে। ফলে খুচড়া ব্যবসায়িরা কম মূল্যে চামড়া কিনছেন এবং বিক্রি করছেন। দিন শেষে দেখা যাবে পাইকারি আড়তদাররা ট্যানারি মালিকদের কাছে ঠিকই নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রি করবেন। খুচড়া পর্যায়ে ভাল ব্যাংক ঋণ না থাকায় খুচড়া ক্রেতারা আড়তদারদের থেকে দাদন নেয়। তাই বাধ্য হয়েই আড়তদারদের কথামতো খুচারা ব্যাপারীদের চলতে হয় বলে মনে করেন তিনি। এই ব্যবসায়িও চামড়া পাচারের আশঙ্কা করছেন।
উল্লেখ্য, সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী, ট্যানারি ব্যবসায়ীরা এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনবেন ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় এবং ঢাকার বাইরে এর দাম হবে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। এছাড়া সারাদেশে খাসির চামড়া ১৮-২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকায় সংগ্রহ করবেন ব্যবসায়ীরা।
গত বছর প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা ও লবণজাত চামড়ার দাম ঢাকায় ৫০-৫৫ টাকা ধরা হয়। ঢাকার বাইরে সারাদেশে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ৪০-৪৫ টাকা। এছাড়া মহিষের প্রতি বর্গফুট চামড়া ৪০ টাকা, খাসির ২০-২২ টাকা এবং ছাগল ও ভেড়ার ১৫-১৭ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়। ২০১৪ সালে দাম ধরা হয়েছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম ধরা হয়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা।
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে সারাদেশ থেকে কমবেশি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এর অর্ধেকের বেশি আসে কোরবানির ঈদের সময়।
আপনার মতামত লিখুন :