অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ : খররৌদ্র। প্রচণ্ড গরম। জ্বলন্ত আকাশ। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। হাজারো প্রত্যয়দৃপ্ত মানুষে ঠাসা। ট্রাক-মঞ্চ। মঞ্চে গাদাগাদি। গণসভা চলছিল। সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মঞ্চে এলেন। আগমনী-শুভেচ্ছা। করতালি। গগন বিদীর্ণ স্লোগান জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ বিরোধী। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দেশবাসীকে জঙ্গি ও স্বাধীনতা বিরোধীদের মদদ দতাদের রুখে দাঁড়ানোর উদাত্ত আহ্বান জানান। শুরু হয় একের পর এক গ্রেনেড হামলা। নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ২৪ জন নিহত। পাঁচ শতাধিক আহত। হামলাটি ছিল পরিকল্পিত এবং বিএনপি জামায়াত সরকারের রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে। চোখের সামনে মৃত্যুর তাণ্ডব দেখলাম।
হামলার পূর্বপর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে বেরিয়ে আসবে এই হামলার নেপথ্যে ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র। সেসময় ধর্মান্ধ জঙ্গি সাম্প্রদায়িক শক্তি গোটা অঞ্চলকে গ্রাস করতে উদ্যত। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পুনরায় ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির ‘স্প্রিং-বোর্ড’ হিসেবে স্থায়ীভাবে জেঁকে বসতে চেয়েছিল। তাদের এই অশুভ পরিকল্পনার মূল বাধা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা। সেজন্যই পূর্বেই তাদের ঘোষণা ছিল ‘হাসিনা মুক্ত বাংলাদেশ’। এ লক্ষ্যে এই হামলার মূল টার্গেট ছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। নেতৃত্ব শূন্যতায় তারা যেন দেশকে ১৫ আগস্ট ’৭৫ পরবর্তী অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে।
২. যেহেতু এই নৃশংস হত্যাকা-ের মামলাটি এখনো বিচারাধীন, সেহেতু বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাওয়া সংগত হবে না। তারপরেও কিছু প্রশ্ন জনমনে থেকেই যাচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত সরকার এই হত্যাকাণ্ডের দায় দায়িত্ব কীভাবে এড়িয়ে যাবে?
প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে পরিষ্কার যে, সমাবেশ ও জননেত্রীর নিরাপত্তা নয়, মাত্র ২৮০ জন পুলিশ ছিল তাও মিছিল ঠেকাতে। যাদের অবস্থান ছিলো সংঘটিত হত্যাকাণ্ড থেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে। জনগণের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, ক. ‘আর্জেস গ্রেনেড’ যা দিয়ে হামলা করা হয়েছিল তা এলো কোথা থেকে? খ. কারা যোগান দিয়েছে? গ. সমাবেশ স্থানে বা পাশের ভবনে নিরাপত্তা রক্ষী ছিলো না কেন? ঘ. কেন বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকারী নিরাপত্তা দেয়া হয়নি? ঙ. পরপর এতগুলো গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলেও নিরাপত্তা রক্ষী ও গোয়েন্দা সংস্থা কি তাদের দায়িত্ব পালন করেছে?
৩. বরং ঘটনাস্থলে আহত অবস্থায় লক্ষ্য করেছি, গ্রেনেড হামলার পর যখন হামলাকারীদের পাকড়াও করতে জনগণ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন তাদের উপর পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। এবং গুলির পরপরই পুলিশ এমন সময় টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে যাতে গ্রেনেড হামলাকারীরা নির্বিঘেœ সটকে পড়তে পারে। এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে হবে। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ, ডিবি, এসবি, অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা, র্যাব, রাট যারাই থাকুন না কেন, শেখ হাসিনার উপর বা তাঁর গাড়ী লক্ষ্য করে যখন আক্রমণ চলছিল তখন তারা কোথায় ছিলেন? সরকারের এই প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার দিকটি চেপে দিতে ‘জজমিয়া নাটক’ সাজানো হয়েছিল কেন? কিন্তু সত্যকে আড়াল করা যায়না।
৪. বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর বারবার এই হত্যা প্রচেষ্টা কেন? এ পর্যন্ত ১৯ বার হামলা হয়েছে। কারণ একটাই। শেখ হাসিনার অপরাধ তিনি জাতির পিতার কন্যা, অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণে অঙ্গীকারাবদ্ধ। দুঃখী মানুষের মুক্তির ব্রত নিয়ে আপোষহীন। সেজন্য তাঁর শত্রু, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক। ঘাতকরা তাঁর পিছু ছাড়ছে না। প্রতিনিয়ত ঘাতকের বুলেট তাঁর পিছু ধাওয়া করছে।
একটি গণতান্ত্রিক কল্যাণকামী, অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন-সাধনা সোনার বাংলা নির্মাণে কোটি কোটি দুঃখী মানুষের মুক্তির প্রদীপ হাতে জননেত্রী শেখ হাসিনা দুহাতে দুঃশাসন ও ঘন অন্ধকার ঠেলে এগিয়ে চলেছেন মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে, সেই পথ-চলা তারা চিরতরে থামিয়ে দিতে চায়, জাতির আশার শেষ প্রদীপটিকেও খুনীচক্র নিভিয়ে দিতে চায়। সেই অশুভ শক্তি এখনো সক্রিয় ও চক্রান্তে লিপ্ত। এদের রুখতে হবে।
লেখক : ৭২ সনের খসড়া সংবিধান প্রণেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সাবেক তথ্যপ্রতিমন্ত্রী
আপনার মতামত লিখুন :