শিরোনাম
◈ নির্বাচনের মাঝেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শনিবার ঢাকা আসছেন ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলার নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো ◈ মুজিবনগর সরকারের ৪০০ টাকা মাসিক বেতনের কর্মচারি ছিলেন জিয়াউর রহমান: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ রেকর্ড বন্যায় প্লাবিত দুবাই, ওমানে ১৮ জনের প্রাণহানি ◈ টাইমের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় বাংলাদেশের মেরিনা (ভিডিও) ◈ দেশের মানুষকে ডাল-ভাত খাওয়াতে ব্যর্থ হয়েছিল বিএনপি : প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত : ১৯ আগস্ট, ২০১৮, ০৪:২৫ সকাল
আপডেট : ১৯ আগস্ট, ২০১৮, ০৪:২৫ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বঙ্গবন্ধুও ছিলেন বড় মাপের এক শিল্পী

ড. আতিউর রহমান : আমাদের মতো করে আমাদের একটি স্বাধীন দেশ হবে। হাজার বছর ধরে এই ভূখ-ের মানুষের মনে, পথে-প্রান্তরে এই স্বপ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছিল। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে এই স্বপ্ন এসে থিতু হয়েছিল তাঁর অন্তরের গহীনে। শেখ মুজিব নামের ইতিহাসের এই বরপুত্রের ‘চোখে ধরা পড়েছিল রূপসী বাংলার স্নিগ্ধ মুখশ্রী/ তাই তাঁর চোখে ধরা পড়েছিলÑ আমার সোনার বাংলা’/ তাই তাঁর চোখে ধরা পড়েছিল মুক্তি-স্বপ্ন প্রিয়/ স্বাধীনতা।’ (নির্মলেন্দু গুণ, ‘পুনশ্চ মুজিবকথা’)। “…শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ …সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।” (নির্মলেন্দু গুণ, স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো)’।  আর সে কারণেই বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অবিচ্ছেদ্য এক সত্ত্বা। আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালি রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি ও বিশ্ব নাগরিক। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই ছিল তাঁদের শেষ কথা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাই তাঁরা মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। আর সে কারণেই সমকালীন কবিদের মুখে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর বঙ্গবন্ধুর মতো শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের নাম সমসুরে উচ্চারিত হতে দেখি। মহাদেব সাহা তাই বলেন, “তুমি কেউ নও, বলে ওরা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান আর নজরুলের/ বিদ্রোহী কবিতা/ বলে তুমি বাংলাদেশের হৃদয়।”(‘ঐ নাম স্বতোৎসারিত’)। বাঙালির দুঃখ বঙ্গবন্ধুর দুঃখ। বাঙালির সুখ বঙ্গবন্ধুর সুখ। বাঙালির স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন।

মানুষকে ভালোবাসার এই গুণই তাঁকে তাঁর জীবন থেকেও বড় করতে পেরেছে। স্বদেশের মানুষ তথা বাঙালির প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসাই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিকে এমন মহিমান্বিত করেছে। আর তাঁকে করেছে অনন্য।

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষের মধ্যে রয়েছে প্রচ- ‘এনার্জি’ বা শক্তি। প্রতিদিনের কর্মকা-ের পরও তার মধ্যে থেকে যায় বেশ খানিকটা উদ্বৃত্ত শক্তি। সেই শক্তি প্রকাশ পায় তার আর্ট বা শিল্পে। এই আর্ট তিনি প্রকাশ করেন নানা নান্দনিক মাধ্যমে। ব্যক্তিত্বের প্রকাশই আর্টের প্রধান লক্ষ্য। সত্য ব্যক্তিত্বের অন্যতম দ্যুতি। সত্যের উপরিভাগ থেকে সেই সরটুকু ছেঁকে নেয়া, সাজিয়ে তোলাই আর্টের প্রধান কাজ। (ছিন্নপত্র নং ১৩১, সতেন্দ্রনাথ রায়কে লেখা চিঠি)। বঙ্গবন্ধুও ছিলেন বড় মাপের এক অসাধারণ শিল্পী। ছিলেন তিনি রাজনীতির নন্দিত কবি। আছেন তিনি নিপীড়িত মানুষের মনে এক অবিস্মরণীয় কিংবদন্তি হিসেবে। দৃঢ় তর্জনী হেলনে, অঙ্গভঙ্গিতে, কথায়, ব্যবহারে, আচার-অনুষ্ঠানে এবং সর্বোপরি ৭ মার্চের কালজয়ী বক্তৃতায় যেভাবে বাঙালির ক্ষোভ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, অপমান, জেদ, অহং, সংযম, স্বপ্ন, প্রতিরোধ, সংকল্পÑ সবকিছুই সমন্বিতভাবে অর্কেস্ট্রার মতো বেজে উঠেছিল তাঁর আবেগ-ঘন কণ্ঠে এবং দেহ ভঙ্গিতে তা শুধু একজন বড় শিল্পীর পক্ষেই মানায়।। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সাধারণ জিনিসকে বিশেষভাবে নিজের করিয়া সেই উপায়েই তাহাকে পুনশ্চ বিশেষভাবে সাধারণের করিয়া তোলাই’ একজন শিল্পীর লক্ষ্য। (সাহিত্যের সামগ্রী, রর চতুর্থ খ-, পৃ. ৬২৪)। বঙ্গবন্ধু খুবই দক্ষতার সঙ্গে সেই কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। স্বদেশকে একটি মানুষের মাঝে খুঁজে পাওয়ার আকুতি ছিল রবীন্দ্রনাথের। তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে তিনি তা উল্লেখ করেছিলেন। সেই ‘তিনি’ যেন প্রবলভাবে উপস্থিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর অবয়বে। বাংলা এবং বাঙালির মঙ্গল চিন্তা ছিল তাঁর সর্বক্ষণের ধ্যান ও মননের বিষয়। তাই তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখলেই সারা বাংলাদেশের মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হতো। আর তিনিও মিশে গিয়েছিলেন এই বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি ধূলিকণার সাথে। আজও তাঁর দীঘল দেহ ছড়িয়ে রয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্বের বাঙালি অধ্যুষিত অন্যান্য এলাকা জুড়ে। প্রতিনিয়তই তাঁর নাম উচ্চারিত হয় বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠে।

বাংলা ও বাঙালিকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন বলেই বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বজুড়েই বাঙালির মানসপটে তাঁর ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’।

১৯৬৯ সনের ৫ ডিসেম্বর তারিখে সোহ্রাওয়ার্দীসহ তিন নেতার মাজারে তিনি বলেছিলেন ‘এক সময় এদেশের বুক হইতে মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা কথাটির সর্বশেষে চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কিছুতে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। …আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ’। (দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৯)। তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন। এরপর থেকে পূর্ব-পাকিস্তান শব্দটি তিনি আর মুখে তোলেননি। তার বদলে বাংলাদেশ শব্দটিই উচ্চারণ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নামের প্রিয় স্বদেশকে স্বাধীন করেছিলেন।

শিল্প ও সংস্কৃতির সাথে তাঁর বন্ধন ছিল নিগূঢ়। শিক্ষকদের তিনি গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। কবি সাহিত্যিকরা ছিল তাঁর আত্মার আত্মীয়। প্রিয় বন্ধু জসিম উদ্্দীন, জয়নুল আবেদিন ছাড়াও কবি সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, অধ্যাপকদের সাথে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। দেশ স্বাধীন হবার আগেই ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে প্রতিশ্রুতি দিয়ের্ছিলেন যে ‘সকল সরকারি অফিস আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু’ করা হবে। একইসঙ্গে তিনি শিল্পী সাহিত্যিকদের উদ্দেশ্যে গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, সূর্য সেনদের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা নির্ভিকভাবে তুলে ধরার আহ্বান জানান। দেশ স্বাধীন হবার পরেও শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীদের সাথে তাঁর সেই আত্মিক সম্পর্ক অটুট ছিল। তাই ১৯৭২ সনের ১-৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে উপহার হিসেবে ‘কচিকাঁচার মেলার’ শিশুদের আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে গিয়েছিলেন উপহার হিসেবে।

রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। এটাও তাঁরই পছন্দে নির্ধারিত হয়েছে। ষাটের দশকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমাবেশে তিনি শিল্পী জাহিদুর রহিমকে এই গানটি গাইবার জন্যে অনুরোধ করতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে সুরে গানটি গাইতো মুক্তিযোদ্ধারা সেই নিয়ে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বিতর্ক উঠলে তিনি সিদ্ধান্ত দেন যে সুরে স্বদেশকে স্বাধীন করেছি সেই সুরই বহাল থাকবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সেই সিদ্ধান্ত প্রজ্ঞাপন আকারে দেশবাসীকে জানিয়ে দেয়। সেই সুরেই গাইছি আমরা আমাদের প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত। এ তথ্যটি সন্জিদা খাতুনের দেয়া।

স্বাধীন বাংলাদেশে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁয়ে ‘বাংলাদেশ লোক ও কারু শিল্প ফাউন্ডেশন’ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু তা প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসেন। গণভবনকে নান্দনিক মর্যাদায় উন্নীত করতে শিল্পী রশীদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেন। হাশেম খানের সাথে ছিল আলাদা সম্পর্ক। তাই শিল্পীদের আঁচড়ে নিরন্তর তিনি জীবন্ত হয়ে ওঠেন। এভাবেই তিনি শিল্পী সাহিত্যিকদের সাথে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন এবং এখনো আছেন। তিনি বরাবরই বই পড়তে ভালবাসতেন। জেলে যাবার সময় পছন্দের বইগুলো নিয়ে যেতেন। আর রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বই তো ছিল তাঁর চিরসঙ্গী। কিন্তু সেখানেও আমলাতান্ত্রিক বাঁধা।

‘কারাগারের রোজনামচা’য় তিনি লিখেছেন, ‘আমার কতগুলি বইপত্র আইবি রিঃযযবষফ করেছে। আমাকে খরব দিয়েছে জবধফবৎ’ং ফরমবংঃ, টাইমস, নিউজ উইক এবং রাশিয়ার চিঠি, কোনো বইই পড়তে দিবে না। পূর্বেও দেয় নাই। …কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারির। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তার কোনো বইই জেলে আসতে দিবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে তারা সকলেই মহাজ্ঞানী ও গুণী।’ (‘কারাগারের রোজনামচা’, ১৭ জুলাই ১৯৬৬)। ২৪ জুলাই ডায়রিতে লিখেছেন ‘কবি গুরু’র কথাগুলো স্মরণ করে একটু স্বস্তি পেলাম।’ যখনই মন খারাপ হতো তখনই তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে মনে আওড়াতেন। নিচের লাইন ক’টি তাঁর ছিল খুবই প্রিয়।

“বিপদে মোরে রক্ষা করো/ এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না করি যেন ভয়।”

এমিল জোলার ‘তেরেসা রেকুইন’ ও শহিদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ তিনি জেলে বসেই পড়েন। সময় পেলেই এসব বইয়ের ওপর তাঁর পর্যক্ষেণও ডায়েরিতে লিখতেন। তাঁর ধানম-ির বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়িতেও ছিল দেশ-বিদেশের নানা বইয়ে ঠাসা এক বিরাট লাইব্রেরি। সময় পেলেই তিনি বই পড়তে ভালবাসতেন। কাজী নজরুল ১৯৪১ সালে ফরিদপুরে ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্সে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘আত্মজীবনী’ থেকে জানতে পারি যে, কাজী নজরল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁকে তিনিই ঐ সম্মেলনে এনেছিলেন। সভা করতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। শেষপর্যন্ত হুমায়ুন কবিরের বাড়িতেই হয় সেই সভা। ঐ দিন নজরুল গান করেছিলেন। তারও ৩০ বছর পর জাতীয় কবির সম্মান দিয়ে তিনি তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশে এনেছিলেন। আমৃত্যু তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারের রূপ’ তিনি জেলে বসে অনুধাবন করেন। করাচীতে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর গাড়িতে করে যখন বিমান বন্দর থেকে শহরে যাচ্ছিলেন তখন সফরসঙ্গী পশ্চিম পাকিস্তানী কয়েকজন আইনজীবী ভাষা আন্দোলনে ভারতের হিন্দুদের উসকানী ও প্রভাব ছিল বলে দাবি করেন। তখন বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশ্যে নজরুলের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’ ‘নারী’ ও ‘সাম্য’Ñ কবিতার অংশ আবৃত্তি করে শোনালেন। শহীদ সহ্রাওয়ার্দী ইংরেজিতে তর্জমা করে তাদের ভুল ভাঙালেন। বঙ্গবন্ধু বরাবরই উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। সারা জীবন তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঠেকিয়েছেন। আক্রান্তদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।

পঞ্চাশের মাঝামাঝি চীনে গিয়ে বাংলায় বক্তৃতার পর সফরসঙ্গী পশ্চিমবাংলার মনোজ বসু বলের্ছিলেন ‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে না। আর পারবেও না। তোমারা বাঙলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।’ ‘চীন দেখে এলাম’- বইতে মনোজ বসু এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত লিখেছেন।

তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবিনগর থানার কৃষ্ণনগরে গিয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দীনের সঙ্গে। জনাব রফিকুল হোসেনের কৃষ্ণনগর হাই স্কুলের দ্বারোদঘাটন করার জন্যে তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে আব্বাসউদ্দীনের গান শুনে অভিভূত হযেছিলেন। ঐ সময় বাংলাভাষার জন্য কিছু করার তাগিদ দিয়েছিলেন আব্বাস উদ্দীন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “নদীতে বসে আব্বাসউদ্দীন সাহেবের গান তাঁর নিজের গলা না শুনলে জীবনের একটা দিন অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতে ছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তারই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তার নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দীনের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। আমি কথা দিয়ে ছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।” (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃ. ১১০-১১১)।

১৯৬৯ সনের ১৩ জুন ঢাকা থেকে ইতালীতে থাকা কন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন মানিক মিয়া ও প্রফেসর হাই সাহেবের মৃত্যুর কথা। ‘বাংলাদেশ দুজন কৃতি সন্তান হারাল’ বলে তিনি তাঁর মর্মজ্বালা প্রকাশ করেছিলেন। তারা যেন তাঁর পরমআত্মীয়। তাই তাদের মৃত্যুতে তিনি মর্মাহত।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী করে তাঁকে কুর্মিটোলায় অস্থায়ী সামরিক কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে বাংলা পত্রিকা ও বই না পেয়ে বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজ নামচায়’ লিখেছেন ‘প্রাণটা আমার হাঁপাইয়া উঠছিল, সহ্য করা কষ্ট কর হয়ে পড়েছিল। বাংলা বই পাওয়ার উপায় নাই, সমস্তই ইংরেজি ও উর্দুতে। হেড কোয়ার্টার লাইব্রেরি থেকে মেজর গোলাম হোসেন চৌধুরী আমাকে দু-একখানা এনে দিতেন। ভদ্রলোকও ভালো লেখা পড়া করতেন। কোনো বাংলা বই বোধ হয়ে সেখানে নাই। খবরের কাগজ পড়া নিষেধ, তাই বাংলা কাগজ পড়ার প্রশ্ন আসে না।’ এভাবেই বাংলা ও বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায় বঙ্গবন্ধু খুঁজে বেড়াতেন মুক্তিপ্রত্যাশী মানুষকে। সেই মানুষেরাই বুকের রক্ত ঢেলে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই মানুষদের কথা তিনি কোনোদনি ভোলেননি। তাঁদের তিনি ‘ধোঁকা’ দিতে পারবেন না বলে বারে বারে স্বগোতক্তি করেছেন। চুয়ান্নর নির্বাচনি প্রচার করার সময়ের একটি ছোট্ট ঘটনাকে যে গুরুত্ব দিয়ে তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে স্থান দিয়েছেন তাতেই আন্দাজ করা যায় তিনি কতোটা সাধারণ মানুষের মঙ্গলাকাক্সক্ষী ছিলেন।

“আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, “বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।” আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, “খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।” আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, “তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।” টাকা সে নিল না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলল, “গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।” নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’ এ রকম আরও অনেক ঘটনা ঘটেছিল। আমি পায়ে হেঁটেই এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়নে যেতাম। আমাকে রাস্তায় রাস্তায়, গ্রামে গ্রামে দেরি করতে হত। গ্রামের মেয়েরা আমাকে দেখতে চায়। আমি ইলেকশনে নামার পূর্বেই জানতাম না, এ দেশের লোক আমাকে কত ভালবাসে। আমার মনের একটা বিরাট পরিবর্তন এই সময় হয়েছিল।” (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃ. ২৫৫-২৫৬)

তিনি যে তাদের কথা কখনও ভোলেননি তা নীচের কযেকটি উদ্ধৃতি থেকেই অনুমান করা যায়।

“আমাদের চাষিরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পিছনে নিয়োজিত করতে হবে। ”

“করাপ্শন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপ্শন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপ্শন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি।” (বঙ্গবন্ধু; জাতীয় সংসদ, ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫)

“আমি কী চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত থাক। আমি কী চাই? আমার বাঙলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাঙলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাঙলার মানুষ আবার প্রাণভরে হাসুক।” (বঙ্গবন্ধু; রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দান, ৯ মে, ১৯৭২)

সাধারণ মানুষের প্রতি গভীর অনুরাগের কারণেই আজ তিনি এতোটা শ্রদ্ধেয়। তাঁর প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্যই ছিল এদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজি মুক্তি নিশ্চিত করা। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসন আমলে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের অবকাঠামো প্রতিষ্ঠান, সংবিধান, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, পররাষ্ট্র নীতিসহ কতো কিছুই না সম্পন্ন করেছিলেন। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল। এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের শত্রুরা পঁচাত্তরের আগস্ট মাসের পনের তারিখে আচমকা আঘাত করে বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধুকে। শারীরিকভাবে তাঁকে তাঁর প্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর স্বদেশ চলতে থাকে এক ‘অদ্ভুত উটের পিঠে’ স্বাধীনতার মূলমন্ত্রের উল্টো পথে। অনেক আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ফের তাঁর কন্যার হাত ধরে এগিয়ে চলেছে সম্মুখ পানে। একই সঙ্গে দিন দিন বঙ্গবন্ধু আরো প্রবল হচ্ছেন। আরো বিরাট হচ্ছেন। ২০২০ সালে আমরা যেন সমৃদ্ধ বাংলাদেশেই সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালির জন্মশতবর্ষ মাথা উঁচু করে উদ্যাপন করতে পারি সেই প্রত্যাশা করছি। তার পরের বছরই স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স হবে পঞ্চাশ। বঙ্গবন্ধুর গরিবহিতৈষী উন্নয়ন কৌশলকে বাস্তবে রূপায়নে ব্রতী হয়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে চাই।

পরিচিতি:  ড. আতিউর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। গত ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। তার গবেষণা-ধর্মী এই লেখাটির কপি। দৈনিক ‘আমাদের নতুন সময়’ পত্রিকায় দিয়েছেন। যা এখানেই মুদ্রিত হলো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়