শিরোনাম
◈ চলচ্চিত্র ও টিভি খাতে ভারতের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করলেই ব্যবস্থা: ইসি আলমগীর  ◈ নির্বাচনের মাঝেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শনিবার ঢাকা আসছেন ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো ◈ মুজিবনগর সরকারের ৪০০ টাকা মাসিক বেতনের কর্মচারি ছিলেন জিয়াউর রহমান: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ রেকর্ড বন্যায় প্লাবিত দুবাই, ওমানে ১৮ জনের প্রাণহানি

প্রকাশিত : ১৮ আগস্ট, ২০১৮, ০৫:৫২ সকাল
আপডেট : ১৮ আগস্ট, ২০১৮, ০৫:৫২ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

চিরদিনের বাতিঘর

মুস্তাফিজ শফি : সারওয়ার ভাই নেই! জীবন থেকে একেবারেই নিয়ে নিয়েছেন ছুটি। খবরটি জানাতে গিয়ে ১৩ আগস্ট সোমবার রাতে বার বার আমাদের বুক কেঁপে উঠেছিল। আঙুল চলছিল না কম্পিউটারের কি-বোর্ডে। কী লিখব, গভীর দুঃখ ও অন্তহীন মর্মবেদনার কথা কি লেখা যায় খুব সহজে? এই তো গত ঈদুল ফিতরের মাত্র কয়েকদিন আগের কথা। তিন দিন ছুটি লাগবে, জানাতে গিয়েছি তাকে। মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'যাও, তবে আগামী ঈদে কিন্তু আমাকে ছুটি দিও।' সম্পাদকের ছুটি নিতে হয় কারও কাছ থেকে? তারপরও তিনি ছুটিতে যাওয়া বা অফিসে অনুপস্থিত থাকার কোনো সম্ভাবনা থাকলেই আগে থেকে আমাকে জানিয়ে রাখতেন। সহাস্যেই বলেছি, 'আপনার ছুটি লাগলে অবশ্যই নেবেন। আগামী ঈদে আমি থাকব।' তখন কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছি চিরতরের জন্য ছুটি নিয়ে নিচ্ছেন তিনি? আর মাত্র কয়েক দিন পরই আমরা ঈদুল আজহা উদযাপন করব, আর সারওয়ার ভাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকবেন তার যুদ্ধে পাওয়া দেশের শীতল মাটির বুকে। যে দেশকে তিনি ভালোবাসতেন। যে দেশের মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন। আর কোনোদিন তার পদচিহ্ন পড়বে না সমকালে, প্রিয় জাতীয় প্রেস ক্লাবে। আর কোনোদিন তাকে টানবে না সন্ধ্যা নদী তীরের বানারীপাড়া। মাটির মানুষ তিনি মিশে যাবেন মাটিতেই।

সারওয়ার ভাই, সমকালের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। একই সঙ্গে রয়েছে আরও আরও পরিচয়- বরেণ্য সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের সভাপতি, প্রেস কাউন্সিলের সদস্য। জীবদ্দশাতেই তিনি পেয়েছিলেন কিংবদন্তির খ্যাতি। তিনি শুধু আমাদের সাংবাদিকতার নন, পুরো জাতিরই অন্যতম বাতিঘর। জীবনের নিয়মেই ব্যক্তি মানুষের জীবনাবসান হয়, মহাসিন্ধুর পথে পাড়ি জমাতে হয় তাকে। তবে গোলাম সারওয়ার তার জীবনব্যাপী কর্মে আমাদের সামনে যে আলো জ্বেলে গেছেন তা অবিনশ্বর। চিরদিনের বাতিঘর হয়েই তিনি রয়ে যাবেন আমাদের মাঝে।

প্রিয় সারওয়ার ভাই, মহাসিন্ধুর ওপার থেকে আপনি অবশ্যই দেখতে থাকবেন, আমরা সামনে এগোচ্ছি আপনার দেখানো আলোর পথ ধরেই। নিরলস শ্রম আর অসামান্য পেশাদারিত্বে পাঁচ দশকের বেশি সময়ের সাংবাদিকতা জীবনে সংবাদপত্রকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে উচ্চতায় আপনি নিয়ে গেছেন, সেখান থেকে আপনার নামটি কে মুছতে পারবে বলেন? এ দেশে সংবাদপত্রের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে বারবার উচ্চারিত হবে আপনার নাম। এক্ষেত্রে আপনি শুধু ব্যক্তি নন, একাই একটি প্রতিষ্ঠান, অতি উজ্জ্বল এক অধ্যায়।

এক অন্যরকম মেলবন্ধন ছিল আমাদের। ছয় বছর আগে সমকালে যোগদানের একান্ত আলাপের কথা মনে পড়ছে। সারওয়ার ভাইকে আমি সরাসরিই প্রশ্ন করেছিলাম, 'আপনি একাধারে সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, সব কাজই তো নিজ হাতে করেন, তাহলে আমাকে দরকার কেন? আমি তো নিজের মতো করে কিছু কাজ করতে চাই, সেই সুযোগ কি আপনার কাছ থেকে পাব?' মৃদু হেসে বলেছিলেন, 'আমি এখন আর একা সব পারি না, আমার দরকার একজন নির্ভরযোগ্য ডান হাত। আমি না থাকলেও যে পত্রিকাটি চালিয়ে যেতে পারবে। সেক্ষেত্রে আমি তোমার ওপর আস্থা রাখতে চাই। আর নতুন কিছু করতে চাইলে অবশ্যই সে সুযোগ পাবে।' সেই আস্থা জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আমার ওপর তার ছিল। ২৯ জুলাই রাতে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করে বাসায় ফিরেছি। পরের দিন তিন সিটিতে নির্বাচন, অফিসে এসে সবার সঙ্গে কথা বলে মনে হলো বিকেলে একবার সারওয়ার ভাইয়ের কাছে যাই, পুরো বিষয়গুলো জানিয়ে একটি গাইডলাইন নিয়ে আসি। আসলে তখনও মনে হচ্ছিল সাধারণ অসুস্থ তিনি। যাওয়ার পর আর বেশি কথা বলতে সাহস হয়নি। অক্সিজেনের মাস্কের ভেতর থেকে তিনি শুধু বললেন, 'তুমি তো আমাদের পলিসি জানোই। সেভাবেই পত্রিকা করো।' প্রতিদিনই হাসপাতালে গেছি, পত্রিকা নিয়ে আর কোনো কথা বলেননি। প্রতিবারই শুধু জানিয়েছি, 'অফিসের সবাই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে, আপনার জন্য দোয়াও করছে। কোনো চিন্তা করবেন না, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন আপনি।' তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছেন, ক্লান্ত ফ্যাকাসে মুখেও ছড়িয়েছেন হাসির আভা।

অন্য কারও সঙ্গে কাজ করলে কী পেতাম সেটা জানি না, তবে এটুকু বলতে পারি, গোলাম সারওয়ারের টিম সমকাল আমাকে পেশাগত জীবনে যা দিয়েছে তা এক অমূল্য সম্পদ। সঙ্গে ব্যক্তি গোলাম সারওয়ারের অগাধ ভালোবাসা, স্নেহ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্রয়ও ছিল। এগুলোই আমাকে সহায়তা করেছে তার উত্তরসূরি হিসেবে গড়ে উঠতে। পুরো টিমকে আরও শক্তিশালী করতে।

মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িকতা, আর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সোচ্চার এ মানুষটিকে আমরা ভুলব কীভাবে? যদি তার কাজের সত্যিকার মূল্যায়ন করা যায় তাহলে তো ভোলার প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংবাদপত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বার্তা বিভাগে গোলাম সারওয়ারের সৃজনশীলতা, সংবাদবোধ ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এ দেশের সংবাদমাধ্যমে উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। দীর্ঘ পেশাগত জীবনের শুরু থেকেই তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্য ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। একজন পেশাদার সাংবাদিক যে কতটা সাহিত্যপ্রেমী হতে পারেন, সাহিত্যকে সংবাদপত্রের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন তিনি তার বড় উদাহরণ। সাহিত্যের অসম্ভব ভালো পাঠকও ছিলেন তিনি। অনেকটাই মুখস্থ ছিল রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ। হালের জয় গোস্বামীও আওড়াতেন মাঝে মাঝে। ছিলেন ক্রীড়া অন্তপ্রাণ। মেধা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার কারণে অনেকে তাকে সাংবাদিকদের শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করেন। আমরা জানি, তার হাতে গড়া পাঁচ শতাধিক সাংবাদিক এখন দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশনে নিজ নিজ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। যাদের বেশ কয়েকজন দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন মাধ্যমের সম্পাদক বা প্রধান সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছেন। তারা অনেকেই গর্বভরে শিক্ষক হিসেবে গোলাম সারওয়ারের নামটি উচ্চারণ করেন। আমিও আজ এই লেখার সুযোগে আমার সাংবাদিকতার অন্যতম শিক্ষক গোলাম সারওয়ারকে আবারও প্রণতি জানালাম।

সারওয়ার ভাই প্রায়ই বলতেন, দেশের প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে নিরপেক্ষ হওয়া যাবে না। এখানে পক্ষপাত থাকতেই হবে। না হয় দেশ এগোবে না, মুখ থুবড়ে পড়বে জাতি। লিখতে বসে আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের সেই উত্তাল দিনগুলোর কিছু কথা মনে পড়ছে। ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড হয়নি। অনেকের মতো সমকালের নিউজ ম্যানেজমেন্টও সেদিন হতাশ। কেউই মানতে পারছিলেন না রায়। পত্রিকায় কাভারেজ কী হবে সেটা নিয়েও ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্ব। বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের একটি উক্তি উল্লেখ করে সেদিন বলেছিলাম- 'আদালতের সমালোচনা করা যাবে না, তবে নির্দিষ্ট কোনো রায়ের সমালোচনা অবশ্যই করা যাবে।' কথাটি শোনার পর সারওয়ার ভাই অসম্ভব ব্যক্তিত্ব নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললেন, 'আমরাও এই রায়ের সমালোচনা করব। জেলে যেতে হলে সম্পাদক হিসেবে আমি যাব।' ইতিমধ্যে আরেক বরেণ্য সাংবাদিক আবেদ খানের একটি লেখা আমার ই-মেইলে এসেছে। আবেদ ভাইও কাদের মোল্লার রায় নিয়ে উত্তেজিত। মেইল খুলে দেখি লেখার শিরোনাম- 'এই রায় মানি না, মানবো না'। আমি দৌড়ে আবার সারওয়ার ভাইর রুমে ঢুকলাম। বললাম, 'যদি রায়ের সমালোচনা আমরা করতে পারি তাহলে এই শিরোনামই প্রথম পাতায় দেন। সেক্ষেত্রে আমি নিজ দায়িত্বে আবেদ ভাইয়েরটা বদলে দেব। তিনি কিছু মনে করবেন না।' কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, 'ঠিক আছে রিস্ক যখন নিবাই, বড়টা নাও।' কিছুটা এডিট করে সমকালের পরের দিনের লিড নিউজের শিরোনাম হলো 'এই রায় মানি না।' শিরোনামটি নিয়ে আমাদের অনেককেই তখন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে, সারওয়ার ভাইকেও। তিনি প্রতিবারই বলেছেন, 'আমরা দায়িত্ব নিয়েই শিরোনামটি করেছি। কারণ, কাদের মোল্লার রায়টি সঠিক হয়নি, এটা আমরা মানি না।' সমকালের শিরোনামটি যে সঠিক ছিল এটা তো এখন ঐতিহাসিক সত্য। গণজাগরণ মঞ্চ হয়েছে। উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ পাওয়া গেছে। পরবর্তী সময়ে কাদের মোল্লার ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে।

গণজাগরণ মঞ্চ শাহবাগে মোমবাতি প্রজ্বালন করল ১৪ ফেব্রুয়ারি। লাখো মানুষ সেখানে অংশ নিলেন। আমার অনুরোধে সারওয়ার ভাই প্রথম পাতার সব বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে দিলেন। পত্রিকার আর্থিক ক্ষতি হলো কয়েক লাখ টাকা। আমরা ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখের পত্রিকার পাতাজুড়ে মোমবাতির ছবি দিয়ে কেবল একটি শিরোনাম লিখে দিলাম, 'আলোর পথযাত্রী'। এই পত্রিকাটিকে এখনও সমকালের সবচেয়ে ভালো মেকআপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সম্পাদক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজ্ঞাপন বাদ না দিলে যা কোনো দিনই করা সম্ভব হতো না। খবরের প্রয়োজনে, পত্রিকার স্বার্থে তাৎক্ষণিক যে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন তিনি। গোলাম সারওয়ার ছাড়া এরকম আপসহীন সাংবাদিক আমরা আর ক'জন পাবো?

এ দেশের সাংবাদিকতাকে, মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে তিনি একটি ভিত্তি দিয়েছেন, সেই ভিত্তির ওপর ভর করে আমাদের পৌঁছাতে হবে নতুন নতুন উচ্চতায়। আর এটাই হবে তাকে ভালোবাসার সর্বোত্তম প্রকাশ। সারওয়ার ভাই, মহাসিন্ধুর ওপার থেকে আপনি নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন, আমরা আপনাকে কত ভালোবাসি।

লেখক:  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক সমকাল।

(লেখাটি সমকাল থেকে সংগৃহীত)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়