সাব্বির আহমেদ: ২০০৩ সালের জানুয়ারী মাস, ঢাকার এখনকার (তখন এক বছরের পুরনো) স্বনামধন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সবে নতুন শিক্ষকতায় ঢুকেছি, আড়াই বছরের মেয়ে, স্কুল, বাসা সামাল দিতে আমি হিমশিম খাই!
তার ওপর ঢাকা শহর নতুন চাকুরী, অচেনা পথ-ঘাট, পাগল পাগল অবস্থা! বাসায় একজন সাহায্যকারী ভীষণভাবে দরকার। মেয়ের বাবার আয়- রোজগার খুব একটা সুবিধের নয় বিধায় টিউশানিও শুরু করতে হলো। সাহায্যকারীর জন্য ধর্না দিচ্ছি যেখানে যখন পারছি।
যখন দম বন্ধ হবার উপক্রম, ঠিক তখনি এককান, দু'কান, বদকান, করে সেই প্রতিষ্ঠানে আমি যার তত্বাবধানে কাজ করি এবং যিনি আমার ইন্টারভিউ যারা নিয়েছিলেন তাদের একজন এর কানে গেলো।
তিনি জানালেন, তাঁর খোঁজে একটি ১৭/১৮ বছর বয়সী মেয়ে আছে, এর সাথে আরো দু/তিন জন আছে যারা তাঁর বাসায় কাজ করে, সো আমি চাইলে মেয়েটাকে নিতে পারি! প্রথমেই বয়সটা ধাক্কা দিলো, সারাদিন বাসায় থাকি না, এই বয়সের একটা মেয়ে!
কিন্তু পরক্ষণেই নিজের মেয়ের চেহারাটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে, বেচারি আমার সাথে স্কুলে আসতে যেতে শুকিয়ে গেছে, প্রতিদিন আনাও ঠিক নয়! নতুন চাকুরী, রাজি হয়ে গেলাম। পরদিন সকালে ঠিকানা অনুযায়ী মেয়েটিকে আনতে গেলাম। হাল্কা- পাতলা, শ্যাম- বর্ণ একটি মেয়ে!
বাসায় নতুন সহকারী এলেই তাকে যে এলেমগুলো দিই আমি, তারমধ্যে অন্যতম হলো পারসোনাল হাইজিন, স্পেশালি মাসের অই বিশেষ দিনগুলোতে তার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারটা। তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়ে মোটামুটি ভালই কাটলো প্রায় মাস খানেক। খুব পরিষ্কার আর গুছিয়ে কাজ করতো।
কেবল স্কুল আর টিউশানি শেষ করে বাসায় ফিরে দেখতাম প্রায় ই শুয়ে থাকতো, ভাবতাম বুঝি টায়ার্ড থাকে- আহা থাক। আমার মেয়েটাকে ভাল রেখেছে আর কি! আর শুধু পোড়া মরিচ ডলা, ঝাল ঝাল ভর্তা দিয়ে ভাত খেতো। বকা দিতাম, গ্যাস্ট্রিক হবে, কে শুনে কার কথা! খা, বেশি করে খা, মরিচ ই তো!
এর মধ্যে ডেকে একদিন জিজ্ঞেস ও করলাম, "এই তোর শরীর খারাপ ( পিরিয়ড) হচ্ছে না কেনো, এক মাস প্রায় পার হলো?" বলল, " আপা আমার প্রায় ৫/৬ মাস হচ্ছে না শরীর খারাপ! আর আমার পেটের ভেতর ভার ভার লাগে, কি যেন নড়ে!" আমার তো তখন দম - বন্ধ অবস্থা ডাকাত মেয়ে বলে কি?
পেটের ভেতর কিছু নড়ার অর্থ সে বুঝে!! তখন বাজে রাত ন'টা। পাঠালাম প্রেগ্ন্যান্সি টেস্ট স্ট্রিপ নিয়ে আসতে, ইউরিনটা টেস্ট করলাম নিজের হাতেই, প্রেগ্ন্যান্সি পজিটিভ। আমি জানতাম, এডভান্স স্টেজে ইউরিন রাতেও চেক করলে পজিটিভ ই আসে, সেক্ষত্রে সকালের প্রথম ইউরিন লাগে না।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো! কি করবো আমি এই মেয়ে নিয়ে, কই যাবো। সাহস সঞ্চয় করে সরবরাহকারীকে ফোন দিলাম, বিস্তারিত বললাম। তিনি নিজেও চিন্তিত। আমি সারারাত তার পাশে শুয়ে- বসে কাটালাম, পাছে ভয়, না কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। সকালে তাকে নিয়ে ছুটলাম যেখান থেকে এনেছিলাম সেখানে রেখে আসবো।
পথে বুঝাতে লাগলাম, হিরো কে, নাম কি, তুই বুঝতে কেন পারিসনি, নিজের এত্ত বড় সর্বানাশ কেন করেছিস? ইত্যাদি ইত্যাদি......। উত্তরে শুধুই কান্না!
লেখক: খুরশিদ জাহান, শিক্ষক।
আপনার মতামত লিখুন :