প্রভাষ আমিন : যতবার যাই, বনানী কবরস্থানে ঢুকতে গেলেই আমি থমকে যাই। বনানী কবরস্থানে ঢুকতেই হাতের বা দিকে এক সারি কবরের সামনে গিয়ে থমকে দাড়াই, ক্ষুব্ধ হই। সেখানে নামফলকে ১৮ জনের নাম লেখা, প্রথম নামটি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেষ নামটি পোটকা। তারপরও নিচে ‘ও লেখা নাম না জানা আরও অনেকে’। ৪৩ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু নিষ্ঠুরতা, নির্মমতাটি এখনো টাটকা। যতবার দেখি ততবার ফিরে আসে শোকের সেই বাণ। অনেকবার আমি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সেই বাড়িটিতে গেছি। বাড়িটির কোণে কোণে নিষ্ঠুরতার চিহ্ন, শোকের আবহ। যতবার গেছি, শোকের পরিমাণ একটুও কমেনি। আমি ভাবতেই পারি না, যিনি একটি জাতির আশা-আকাঙ্খাকে ধারণ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এনে দিয়োছিলেন, যার বুক ভরা ছিল এই দেশের জন্য, এই দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা, যাকে পাকিস্তানিরা বারবার হত্যা করতে চেয়েও পারেনি; তার বুকে কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের সৈন্যরা গুলি ছুড়তে পারে?
এখন বাংলাদেশে লাখ লাখ বঙ্গবন্ধু প্রেমিক। কিন্তু ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর অবস্থাটা ভিন্ন ছিল। ২১ বছর বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হয়, তখন দেশজুড়ে দারুণ এক আবেগের ঢেউ খেলে গিয়েছিল। সময়ের কারণে সেই আবেগ অনেকটাই থিতিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগের অতি ব্যবহার আর দলীয়করণই বঙ্গবন্ধুর প্রতি সেই উত্তাল আবেগ থিতিয়ে আসার জন্য কিছুটা দায়ী। তবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা কমেনি। বঙ্গবন্ধুর দুটি বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রকাশের পরও আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের আবেগ কতটা শুদ্ধ। দুটি বইই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রিত। তবে কতটা পঠিত সে নিয়ে সন্দেহ আছে। পড়লেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর বই দুটি কতটা আত্মস্থ করতে পেরেছে বা করতে চাইছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অন্তত এখনকার অনেক নেতাকর্মীর কার্যকলাপ দেখলে মনে হয় তারা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী কিনেছেন কিন্তু পড়েননি বা পড়েছেন কিন্তু আত্মস্থ করতে পারেননি। সুযোগ থাকলে আমি বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক কর্মীকে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ বাধ্যতামূলক করতাম। অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে একটি মানুষ কীভাবে একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারে, এ বইটি পাঠ করলে সবাই তা জানতে পারবে।
আচরণ দলীয় কর্মীর মতো হলেও অনেক সাংবাদিক নিজেদের নিরপেক্ষ দাবি করেন। আমি কখনোই নিজেকে নিরপেক্ষ দাবি করি না। নিরপেক্ষতার ব্যাপারে আমার অবস্থান পরিষ্কার। আমি দল নিরপেক্ষ, তবে আদর্শ নিরপেক্ষ নই। আমি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের প্রশ্নে আমি নিরপেক্ষ নই। আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চাই। আর এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন যিনি দেখিয়েছিলেন, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রশ্নেও আমার কট্টর পক্ষপাত। আমি নিরপেক্ষতার ভান না ধরে সব সময় বঙ্গবন্ধুর কথা বলি। আমি চাই বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি বলে কিছু থাকবে না, থাকলেও স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের রাজনীতি করার অধিকার থাকবে না। সরকারি দল, বিরোধী দল সবাই হবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। আমি চাই, জাতির পিতা প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দলের অভিন্ন অবস্থান থাকবে।
আমি জানি, একদিন না একদিন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী সর্বজনীনভাবে পালিত হবেই। তবে এখন সর্বজনীনভাবে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী পালনের সবচেয়ে বড় বাধা আওয়ামী লীগই। দলটি বঙ্গবন্ধুকে এমনভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছে যে, আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেকেই বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে ফেলেন। আওয়ামী লীগার হয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকে বঙ্গবন্ধুর ন্যায্য প্রশংসাটাও করেন না। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রণ স্লোগান। এ দুটি শব্দবন্ধ একসঙ্গে, এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হতো। কিন্তু আজ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেকেও ‘জয়বাংলা’ বলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের সিল লেগে যাওয়ার ভয়ে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ করেন না। এ আসলে আমাদের হীনমন্যতা। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের একার সম্পদ নয়, তিনি জাতির পিতা।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আদিখ্যেতা বেশি হলো, চামড়া বাঁচাতে বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা নব্য আওয়ামী লীগার, হাইব্রিড আওয়ামী লীগার আর সারা জীবন বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে আসা রাজনীতিবিদদের মধ্যে। কিন্তু আমি নিশ্চিত তারা যত জোরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজিয়ে মানুষকে বিরক্ত করেন, হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য ততটা মমতা পোষণ করেন না। পোস্টারজুড়ে নিজের ছবি দিয়ে কোনায় বঙ্গবন্ধুকে স্ট্যাম্প সাইজ করা আওয়ামী লীগাররা বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করেন নিজেদের প্রচারের জন্য। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে এই হাইব্রিড মৌসুমি বঙ্গবন্ধু প্রেমিকদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বঙ্গবন্ধু একজন অতি সাধারণ মানুষ থেকে হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ একজনে। কিন্তু জাতির পিতা হওয়ার পরও ছিলেন অতি সাধারণই। তিনি গণভবনে থাকেননি, বঙ্গভবনে থাকেননি, থেকেছেন ধানমন্ডির অতি সাধারণ বাড়িতে। শেষ পর্যন্ত সে বাড়ি ছিল সবার জন্য খোলা। এখনো সেই বাড়ি সবার জন্য খোলা। তবে এখন সেটা বঙ্গবন্ধু জাদুঘর। তবে সেখানে গেলে যে কেউ চমকে যাবেন দেশের রাষ্ট্রপতি কি সাধারণ জীবন-যাপন করতেন।
প্লিজ, সাধারণের বঙ্গবন্ধুকে সাধারণেরই থাকতে দিন। তাকে বিচ্ছিন্ন করবেন না। ঘাতকরা অনেক চেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছতে পারেনি। পারবে যে না, সেটা অনেক আগেই জানতেন অন্নদাশঙ্কর রায়- যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মজিবুর রহমান…।
লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
আপনার মতামত লিখুন :