ডেস্ক রিপোর্ট : 'গোলাম সারওয়ার কী ছিলেন, এখনই তা বুঝতে পারব না। তিলে তিলে টের পাব। বানারীপাড়াবাসী তাদের গৌরবের ধনকে হারাল'- অশ্রুসিক্ত চোখে এ কথা বলছেন বানারীপাড়ার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুতে মঙ্গলবার পৌর শহরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়। তিন দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করে বানারীপাড়ার সব মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রেস ক্লাব। কালো পতাকা উড়ছে বানারীপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা, সামাজিক ও পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানে। শোক জানিয়ে ব্যানার টানানো হয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে। মঙ্গলবার বানারীপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, ভাষাহীন শত শত মলিন মুখ। শোকে হতবিহ্বল মানুষ যেন ভেতর থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে তাদের অতি আপনজন গোলাম সারওয়ারকে হারিয়ে।
দেশবরেণ্য সাংবাদিক ও সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রচারের পর পরই শুধু বানারীপাড়া নয়, বরিশাল নগরীর রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিক মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে সমকালের বরিশাল ব্যুরোতে এ সম্পর্কে জানতে অনেকেই ফোন করেন।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আক্কাস আলী খান। গোলাম সারওয়ারের স্কুলজীবনের বন্ধু তিনি। শিক্ষকতাও করেছেন একসঙ্গে, একই প্রতিষ্ঠানে। 'দুলাল আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, কখনও ভাবিনি। খবরটা শোনার পর থেকে সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আছে'- কান্নায় ভেঙে পড়ে কথাগুলো বলছিলেন আক্কাস আলী খান। গোলাম সারওয়ারের ডাক নাম ছিল দুলাল। বন্ধু আক্কাস আলী খান বলেন, স্কুলজীবনে একসঙ্গে পড়েছি, চাকরীজীবনেও ছিলাম একসঙ্গে। ছোটবেলা থেকেই প্রচুর পড়াশোনা করত দুলাল। প্রতিদিন ক্লাসে পাশাপাশি বসতাম।
মুক্তিযুদ্ধে একসঙ্গে রণাঙ্গনে ছিলেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তরুণ নারায়ণ ঘোষ। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সারওয়ার তার পরম বন্ধু ছিলেন। তার মতো আপনজন হারানোর বেদনা বড়ই কঠিন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার ভাইয়ের ছেলে অনুপ কুমার গুহ বলেন, তাদের মাথার ওপরের ছায়া চলে গেল। বানারীপাড়ার গৌরবের ধন গোলাম সারওয়ার সারাদেশকে তার কর্মের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন।
অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষা-সাংস্কৃতিক পরিষদের সম্পাদক প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে কখনও আপস করেননি গোলাম সারওয়ার। তার মৃত্যুতে বানারীপাড়াবাসী হারিয়েছে এক দরদী অভিভাবককে।'
'তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন, বানারীপাড়াবাসীর মতো আমিও আমার পিতৃসম এক অভিভাবককে হারালাম। ব্যক্তিজীবনে এ ক্ষতি অপূরণীয়'- চোখের জল মুছতে মুছতে এ কথা বলেন বানারীপাড়া পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র শীল।
সোমবার রাত সাড়ে ৯টার মধ্যেই বানারীপাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুর খবর। পৌর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে গোলাম সারওয়ারের বাসভবন 'সিতারা'য় বাড়তে থাকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভিড়। শোকার্ত শত শত মানুষকে তখন সান্ত্বনা দেন গোলাম সারওয়ারের ছোট ভাই বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র গোলাম সালেহ মঞ্জু মোল্লা। পিতৃতুল্য বড় ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে মঞ্জু মোল্লাও ছিলেন শোকে মুহ্যমান। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাওলাদ হোসেন সানা, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা শরীফ উদ্দিন আহম্মেদ কিসলু, সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল জলিল ঘরামী, সৈয়দকাঠি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান, বিশারকান্দির চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম শান্ত, বানারীপাড়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে গোলাম সারওয়ারের বাসভবনে আসা পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সান্ত্বনা দেন।
আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ শুনে স্বরূপকাঠি থেকেও মঙ্গলবার রাতে ছুটে এসেছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হামিদ, সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম, কাজী সাইফুদ্দিন তৈমুর, কাউন্সিলর নূরুল ইসলাম ও জাহিদ হোসেন বিপ্লবসহ অনেকে।
২০০৯ সাল থেকে বানারীপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন গোলাম সারওয়ার। মঙ্গলবার সকালে ওই বিদ্যালয়ে ছিল শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা ছিলেন শোকার্ত, ভারাক্রান্ত। সকাল ১০টায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন শেষে বিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে তিন দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. আবু বক্কর সিদ্দিক। জাতীয় পতাকার পাশাপাশি বিদ্যালয়ে উত্তোলন করা হয় কালো পতাকা। একইভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয় বানারীপাড়া সরকারি মডেল ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্বাধীনতার পর পর দীর্ঘদিন এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন গোলাম সারওয়ার।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. আবু বক্কর সিদ্দিক এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেন জানান, মঙ্গলবার থেকে উপজেলার প্রত্যেকটি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিন দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এ তিন দিন প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলনসহ কালো ব্যাজ ধারণ করবেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা।
বানারীপাড়া বন্দর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান জানান, বুধবার থেকে বন্দরের ব্যবসায়ীরা তিন দিনের শোক কর্মসূচি পালন শুরু করবেন। গোলাম সারওয়ারের প্রতি সম্মান জানাতে আজ বন্ধ থাকবে বন্দরের সব দোকানপাট। তিনি বলেন, বানারীপাড়াবাসী শেষবারের মতো তাদের প্রিয় মানুষ গোলাম সারওয়ারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ও তার মুখ দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছেন।
সূত্র : সমকাল
আপনার মতামত লিখুন :