শিরোনাম
◈ বাংলাদেশের রাজনীতির অবনতি দুঃখজনক: পিটার হাস ◈ সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বাড়লো ১০ টাকা  ◈ নির্বাচনি ইশতেহারের আলোকে প্রণীত কর্মপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের আহবান শিল্পমন্ত্রীর  ◈ প্রচণ্ড গরম থেকেই ঘটতে পারে মানবদেহের নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি ◈ অবশেষে রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি  ◈ ইসরায়েল পাল্টা হামলা করলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জবাব দেবে ইরান: উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ মিয়ানমারের আরও ১০ সেনা সদস্য বিজিবির আশ্রয়ে ◈ সয়াবিনের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই: বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত বিএনপির ◈ কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকি, আইনের শাসনে জীবনযাপন করি: ড. ইউনূস

প্রকাশিত : ১৪ আগস্ট, ২০১৮, ১১:২২ দুপুর
আপডেট : ১৪ আগস্ট, ২০১৮, ১১:২২ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ঈদুল আজহা ও কোরবানি

মোঃ আমানুল্লাহ আমান : ঈদুল আজহা ইসলাম ধর্মাবলম্বিদের সবচেয়ে বড় দু'টো ধর্মীয় উৎসবের একটি। বাংলাদেশে এই উৎসবটি কোরবানির ঈদ নামেও পরিচিত। ঈদুল আজহার অর্থ হলো ত্যাগের উৎসব। আসলে এটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ত্যাগ করা। এ দিনটিতে মুসলমানেরা তাদের সাধ্যমত ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী গরু, উট, দুম্বা কিংবা ছাগল কোরবানি বা জবাই দেয়। আত্মত্যাগ ও মানবতার বার্তা নিয়ে দুয়ারে হাজির হয় প্রতিবছর। জিলহজ্বের দশ তারিখে পালিত হয় বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও সৌহার্দ্যপূর্ন এই ইবাদত।

কোরবানির ইতিহাসঃ

বিভিন্ন বর্ননা অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তাআলা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)কে স্বপ্নে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কোরবানি করার নির্দেশ দেন। এই আদেশ অনুযায়ী হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার সবচেয়ে প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করার জন্য প্রস্তুত হলে মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে পুত্রের পরিবর্তে পশু কুরবানির হয়। এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্ঠি অর্জনের জন প্রতি বছর এই দিবসটি পালন করে থাকে। হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসাবে জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৩ দিন ধরে ঈদুল আজহা পালন করা যায়। হিজরি চন্দ্র বছরের গণনা অনুযায়ী ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার মাঝে ২ মাস ১০ দিন ব্যবধান থাকে। দিনের হিসেবে যা সবোর্চ্চ ৭০ দিন হতে পারে।

কোরবানি কার ওপর ওয়াজিবঃ

প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ জিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যান্ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে, তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলংকার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র (যেমন-টেলিভিশন, রেডিও, খেলনার সরঞ্জামাদি) কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। আর নেসাব হলো- সোনার ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রুপার কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোন একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্যের হয়ে যায়, তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। (*আল মুহিতুল বোরহানি: ৮/৪৫৫ ও ফতোয়ায়ে শামি: ৫/২২২)। তবে কোরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরী নয়; বরং কোরবানির তিনদিনের মধ্যে যে কোন দিন থাকলেই কোরবানি ওয়াজিব হবে। (*রদ্দুল মুহতার :৬/৩১২)। রাসুল (সাঃ) এরশাদ করেন-“যে ব্যাক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।” (*সুনানে ইবনে মাজাহ :৩১১৪)। সুদ ভিত্তিক ব্যাংকের সাধারণ কর্মচারী লেভেলের চাকুরীজীবির বেতন হারাম নয়, তবে সন্দেহযুক্ত। তাই সে কারো কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়ে কোরবানি করবে। (*আপকে মাসাইল আওর উনকা হল :৬/২৫২)। দরিদ্র ব্যক্তির ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়। কিন্তু সে যদি কোরবানির নিয়তে কোন পশু ক্রয় করে, তাহলে তা কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায়। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/১৯২) । ছেলে কোরবানির পশু ক্রয় করে পিতার (নামে) পক্ষ থেকে কোরবানি দিলে পিতার ওয়াজিব কোরবানি আদায় হবে না। বরং পিতার জন্য পৃথকভাবে পশু ক্রয় করে বা ঐ পশুতে নিজের মালিকানার অর্থ দিয়ে শরিক হয়ে কোরবানি আদায় করতে হবে। (*ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ৫/৩০২) । মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি করা জায়েজ। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে, তাহলে সেটি নফল কোরবানি হিসেবে গণ্য হবে। কোরবানির স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্বীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যাক্তি কোরবানি ওসিয়ত করে যায়, তাহলে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। বরং গরিব-মিসকিনদের মাঝে সদ্কা করে দিতে হবে। (*মুসনাদে আহমদ :৮৪৫ ও ইলাউল সুনান :১৭/২৬৮)।

উপযুক্ত পশু ও শরিকের মাসায়েলঃ

যে পশুটি কোরবানি করা হবে, তার ওপর কোরবানিদাতার পূর্ণ মালিকানা (স্বত্ত্ব) থাকতে হবে। বন্ধকি পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না। গৃহ পালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু (যেমন- হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি) দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নয়। তেমনি ভাবে হাঁস-মুরগী বা কোন পাখি দ্বারাও কোরবানি জায়েজ নয়। (ফতোয়ায়ে কাজিখান :৩/৩৪৮)। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা কেবল একজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যাবে। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে কোরবানি করলে কারোর কোরবানিই সহিহ হবে না। আর গরু, উট, মহিষে (যে কোন সংখ্যায়) সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারবে। (*সহিহ মুসলিম :১৩১৮/৩৫১) গরু ও মহিষের দু-বছর এবং উঠ পাঁচ বছর পূর্ণ হলে তা দিয়ে কোরবানি করা জায়েজ। ছাগল, দুম্বা, ও ভেড়া এক বছর পূর্ণ হতে হবে। (*মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক রহ. :৭৫৪)। তাছাড়া হজরত জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) এরশাদ করেন-

‘তোমরা (কোরবানির জন্য) মুসিন্নাহ ছাড়া জবাই করো না। (মুসিন্নাহ হলো- ৫বছর বয়সী উট, ২বছরের গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে ১ বছর) যদি সম্ভব না হয়, তাহলে ছয় মাস বয়সী ভেড়া বা দুম্বা। (*সহিহ মুসলিম :১৯৬৩)। জবাই করার সময় বিস্মিল্লাহ বলতে হয়। স্বেচ্ছায় বিস্মিল্লাহ না বললে ঐ পশুর গোশত খাওয়া বৈধ নয়। (*আল বাহরুর রায়েক :৮/১৬৮)। জবাই করার সময় বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার পাঠের পর (আল্লাহুম্মা হা-যা মিনকা ওয়ালাকা) ‘হে আল্লাহ, এটা তোমার তরফ থেকে তোমারই জন্য’ বলা যেতে পারে। যার পক্ষ থেকে কোরবানি করা হচ্ছে, তার নাম উল্লেখ করে দোয়া করা জায়েজ আছে। এভাবে বলা- ‘হে আল্লাহ, তুমি অমুকের পক্ষ থেকে কবুল করে নাও।’ হজরত আয়েশা (রা.) সুত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) কোরবানির দুম্বা জবাই করার সময় বললেন- ‘আল্লাহর নামে, হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মদ ও তার পরিবার-পরিজন এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করে নিন।’ (*সহিহ মুসলিম :১৯৬৭)।

ঈদুল আজহার দিনের সুন্নত কাজ সমূহঃ
১। ভোরে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠা।
২। মেসওয়াক করা।
৩। গোসল করা।
৪। যথা সাধ্য উত্তম পোষাক পড়া।
৫। সুগন্ধি বা খুশবু লাগানো।
৬। ঈদগাহে যাবার আগে কিছু না খাওয়া।
৭। রিকসা, ভ্যান, ঘোড়া বা অন্য কোন কিছুতে চড়ে ঈদগাহে না যাওয়া; বরং পায়ে হেঁটে যাওয়া।
৮। যাবার সময় তাকরীর “আল্লাহু আক্বার আল্লাহু আক্বার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আক্বার আল্লাহু আক্বার অলিল্লাহিল্ হাম্দ” জোরে জোরে বলে যাওয়া।
৯। এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া, অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা।
১০। ঈদুল ফিতরের তুলনায় আজহারের নামাজ সকাল সকাল পড়া।

কোনবানির পশু জবেহ করা বিষয়েঃ
১। নিজ পশু নিজেই জবেহ করা উত্তম। না পারলে জবেহের সময় সামনে উপস্থিত থাকা।
২। জবাই করার সময় পশুটি সম্পূর্ন নিস্তেজ হওয়ার পর বাকী কাজ শুরু করা।
৩। জবাই করার আগে বেশী পরিমাণ পানি খাওয়ানো। প্রানীকে ক্ষুধার্থ রাখা জুলুম।
৪। গোশত দিয়ে কোন পারিশ্রামিক না দেওয়া।
৫। গোশত তিন ভাগ করে- ১. নিজে ২.আত্বীয়-স্বজন ৩. গরীব-মিসকীনদের দেয়া।

পরিবেশগত সতর্কতাঃ
১। আমাদের পরিবেশ ও চার পাশ আমাদের পরিস্কার রাখাই দায়িত্ব।
২। অন্যের চলাচলে কষ্ট যাতে না হয় সে দিকে খেয়াল রাখা।
৩। জবেহ করার আগেই মাথার কাছে গর্ত করে নেওয়া; যাতে রক্ত ওখানে গড়িয়ে যায়।
৪। সকল বজ্র ঐ গর্তে ফেলতে হবে; যাতে করে দূর্গন্ধ না ছড়ায়। পশুর কোরবানির বজ্র যাতে অন্য কারো কষ্ট না হয়।

পরিশেষে কোরবানির ঈদ আমাদের কাছে আত্মশুদ্ধি, আত্মতৃপ্তি ও আত্মত্যাগের এক সুমহান বার্তা নিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় দুয়ারে কড়া নাড়ে। তাই ঈদুল আজহার পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃত পক্ষে মানুষের মাঝে বিরাজমান পশুশক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুগুলোকেই কোরবানি করতে হয়। হিংসা, হানাহানি ও বিদ্বেষ ভূলে একসঙ্গে এক কাতারে পবিত্র কোরবানির আনন্দে শামিল হয়ে সবার মাঝে সাম্য ও সহমর্মিতা মনোভাব গড়ে উঠুক। আল্লাহ তায়ালা কোরবানি দাতাকে সাবধান করেছেন- ‘কোরবানি কেবল পশু জবাই করার নাম নয়। নিজের পশুত্ব, ক্ষুদ্রতা, নীচুতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, আমিত্ব ও অহংকার ত্যাগের নাম কোরবানি। কোরবানির পশুর গোশতও আল্লাহর কাছে পৌছে না, তাদের রক্তও না। কিন্তু তার কাছে পৌছায় কেবল তোমাদের তাকওয়া।’ মূলত কোরবানি হচ্ছে একটি প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহর জন্য বান্দার আত্বত্যাগের একটি উপমাত্র। কোরবানি থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় নিজ সম্পদ অন্যের কল্যাণে ব্যয় করার মনোভাব গড়ে ওঠলে বুঝতে হবে কোরবানি স্বার্থক হয়েছে। আর না হয় এটি নামমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে চিরকাল।

লেখকঃ সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সহকারী প্রকল্প কর্মকর্তা ও অফিস ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়