শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু, মানতে হবে কিছু নির্দেশনা ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা

প্রকাশিত : ১৪ আগস্ট, ২০১৮, ০৮:০১ সকাল
আপডেট : ১৪ আগস্ট, ২০১৮, ০৮:০১ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কোনো কিছুতেই পিছু হটছে না চীন

ডেস্ক রিপোর্ট : ২০০৮ সালের ৮ আগস্ট। স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে বিশ্বকে তাক লাগানো স্টেডিয়াম ‘বার্ডস নেস্ট’-এ বেইজিং অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত হলো চীন। এ চীন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। যাদের অন্তরে বিশ্বমঞ্চে রাজ করার বাসনা তখন সবেমাত্র দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়ামের নকশা করেছিলেন শিল্পী আই ওয়েউই, যিনি এখন জার্মানিতে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। কিছুদিন আগে চীন সরকার তার স্টুডিওটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি কীভাবে শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে বিশ্ব জনমতের তোয়াক্কা না করে আগ্রাসীভাবে আবির্ভূত হচ্ছে, এটি তার অন্যতম একটি উদাহরণ।

একসময় চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা সবকিছুতেই পশ্চিমাদের অনুসরণ করে চলে। সেই চীন এখন সম্পূর্ণ নিজস্ব নীতিতে চলছে। এমনকি নিজেদের নীতির কারণে যদি কারো সঙ্গে বিবাদের ঝুঁকিও থাকে, তাতেও তারা পিছু হটছে না। গত মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনে শি জিনপিং চীনের উচ্চাভিলাসী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে পথে চলার ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাতে পশ্চিমা পুঁজিবাদী গণতন্ত্র বা মানবাধিকার উপেক্ষিত থাকবে।

দক্ষিণ চীন সাগর এবং অন্যত্র চীনা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি এখন আরও বেশি স্পষ্ট ও শক্তিশালী। একই সঙ্গে চীনের শত শত বিলিয়ন ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে সমুদ্র ও স্থলপথে চীনের বাণিজ্য স্বার্থ আরও ত্বরান্বিত হবে। প্রকল্পটি বিশ্বজুড়ে চীনের প্রভাব অারও শক্তিশালী করলেও দেশটিকে কিছু সমস্যারও মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কলম্বিয়া, মালয়েশিয়াসহ আরও কিছু দেশের স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও সরকার বড় বড় চীনা প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। দুর্নীতি এবং চীনের অতিমাত্রায় হস্তক্ষেপের অভিযোগে কয়েকটি দেশ মাঝে মাঝে পুরো প্রকল্পই বাতিল করে দিচ্ছে।

সংখ্যালঘুদের ওপর নিয়মিতভাবে ব্যাপক ধরপাকড় চালাচ্ছে চীন সরকার। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এটি আরও বেড়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর চালানো নির্যাতনের ব্যাপারে চীনের ক্ষমতাসীন দল কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সম্প্রতি বিচলিত মনে হচ্ছে।

চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ জিনজিয়াংয়ে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলমানদের বাস। চীন সরকার আনুমানিক ১ থেকে ১০ লাখ উইঘুর মুসলমানকে বন্দিশালায় আটকে রেখেছে বলে অভিযোগ করেছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তাদের দাবি, এটিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্দিশালা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শি জিনপিংয়ের অভিযানে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দও আছেন। এমনকি দুর্নীতিতে অভিযুক্তরা বিশ্বের যেসব দেশে অবস্থান করছে, চীন সরকার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে অনুরোধ করছে, তারা যাদে অভিযুক্তদের চীনে ফেরত পাঠায় এবং তাদের সম্পদ জব্দ করে।

চীন সে দেশের নীতি-নির্ধারক ও পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞদের জন্য নতুন নিয়ম চালু করেছে। এ নিয়ম অনুসারে বিদেশ ভ্রমণের জন্য তাদের সরকারের অনুমতি নিতে হবে। চীনের উচ্চপদস্থ পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞদের এক সপ্তাহ বা তারও কম সময়ের জন্য বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়, তাও সেটি অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর। অনেক সময় বিদেশ ভ্রমণের সরকারি অনুমতি পেতে তাদেরকে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করতে হয়। ফলে চীনের বাইরের বিশ্ব সম্পর্কে তাদের ভালো ধারণা পাওয়ার পথ আরও সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ সুযোগটিরই সদ্ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে যে চীনবিরোধী মনোভাব দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছিল, এটা চীন ভালোভাবে বুঝতে পারেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধের হুমকি দিলো, চীন ভেবেছিল এটি ট্রাম্পের ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু তারা যদি যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ওঠা চীনবিরোধী মনোভাবের ব্যাপারে স্পষ্ট থাকত, তাহলে তারা ট্রাম্পের ওই হুমকিকে উপেক্ষা করতে পারত না। তারা আগে থেকেই সতর্ক হয়ে যেতে পারত। ফলে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ (চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত মার্কিন শুল্ক আরোপ) শুরুর পর চীন যে বিপদে পড়েছে, তা কিছুটা হলেও কম হতো।

অবশ্য ঘরে-বাইরে নানা সমস্যার মুখোমুখি হলেও চীন বিশ্বকে নিজেদের মতো করে গড়ার উচ্চাভিলাস থেকে পিছু হটছে না। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ই এখন নিজের ঘর সামলাতে ব্যস্ত। চীন এই সুযোগটির সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার করতে চাইছে।

উত্তর কোরিয়া যখন একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিচ্ছে, তখন ট্রাম্প প্রশাসন কিম জং-উনকে থামাতে পাল্টা হুমকি দেওয়া শুরু করে। তাতেও খুব একটা কাজ হচ্ছিল না। এটা পরিষ্কার যে, চীনের হস্তক্ষেপেই কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি ফিরে আসে। উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করেন, যেটা মাত্র কয়েক মাস আগেও অকল্পনীয় ছিল। কিম নিজেও কয়েক দফা চীন সফর করেন। গত বছর দীর্ঘ দিন ধরে জিম্বাবুয়ের ক্ষমতায় থাকা রবার্ট মুগাবে সরকারকে উৎখাতে চীনের স্পষ্ট ভূমিকা ছিল। একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চীন। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশকে চীন ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। চীন দাবি করছে, অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য দেশগুলোকে এ ঋণ দিচ্ছে তারা।

আরও পড়ুন: চীনে ঝুঁকছে আফ্রিকা

হুমকি চীনের আরেক বড় অস্ত্র। তাইওয়ানকে চীন সব সময় নিজেদের একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে মনে করে। যদিও তাইওয়ান নিজেদেরকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে প্রচার করে। তাইওয়ানকে দমাতে চীন এবার আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থাগুলোকে হুমকি-ধামকি দেওয়া শুরু করেছে। যেসব এয়ারলাইন্স কোম্পানি তাদের ওয়েবসাইটে তাইওয়ানকে রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, সেসব কোম্পানিকে চীন এ বর্ণনা পরিবর্তনের জন্য চাপ দিয়েছে। এসব এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে অনেকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চীনের এ হুমকিকে ‘উদ্বেগজনক’ আখ্যা দিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চীনের কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছে। কেউ তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে না। কিন্তু চীন এ রীতি ভঙ্গ করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ স্বত্বেও অনেকগুলো এয়ারলাইন্স চীনের দাবি মেনে নিজেদের ওয়েবসাইটে পরিবর্তন এনেছে। ডেল্টা এয়ারলাইন্স তাইওয়ানকে দেশ না বলে ‘অঞ্চল’ হিসেবে তাদের ওয়েবসাইটে লিপিবদ্ধ করেছে। ব্রিটিশ এয়ারলাইন্স তাইওয়ানকে চীনের প্রদেশ হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স চীনের হুমকিকে উপেক্ষা করে বলেছে, তাইওয়ান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।

লাতিন আমেরিকা ও সাব-সাহারান আফ্রিকার দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেও চীনের অনীহা নেই। ফলে এসব অঞ্চলেও চীনের প্রভাব বেড়ে চলেছে। বছরের পর বছর ধরে চীন প্রভাব বিস্তারের এ স্বতন্ত্র কৌশল চাতুর্যের সঙ্গে ধরে রেখেছে। তবে কিছু সমস্যার মোকাবেলাও করতে হচ্ছে দেশটিকে। চীন সরকারের প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, জাম্বিয়া ও অ্যাঙ্গোলার মতো ছোট ছোট দেশগুলোর অর্থনীতি পড়তির দিকে থাকায় সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চীনা নাগরিক স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছে। বিভিন্ন অনুন্নত দেশ থেকে চীনা নাগরিকদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই গত মাসে মালয়েশিয়া তাদের দেশ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগ বাতিল করে দিয়েছে। বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগে অবকাঠামো খাতের বড় এ চীনা বিনিয়োগ বাতিল করে দেশটি। লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল, চিলি ও পেরুর মতো দেশে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে চীন এখন সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ অঞ্চলের দেশগুলোর খুব খারাপ সম্পর্ক যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও চীনের দিকে অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়ার বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হচ্ছে। এ বছর চীনের খাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে নিকারাগুয়ায় বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। এমনকি সামরিক ও কূটনৈতিক অনেক দিক থেকে চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা রাশিয়াও চীনের ব্যাপক প্রভাবে ব্যাপারে, বিশেষ করে মধ্য এশিয়ায় চীনের অতিরিক্ত প্রভাবের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে।

অবশ্য চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি এসব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কান দিচ্ছে না। গত এক দশকে চীনের আচরণ দেখলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, চীন চাচ্ছে বাইরের বিশ্ব তাদেরকে পছন্দ করার থেকে যাতে বেশি ভয় পায়।

সূত্র: রয়টার্স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়