মো: রায়হান ওয়াজেদ চৌধুরী: প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ইন্টারনেট এখন সবার হাতের নাগালে। যার সুবাদে খুবই জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে ফেসবুক এর ব্যবহার বেড়েই চলছে। আবার এই ফেসবুক অপব্যবহার করে অপরাধও সংগঠিত হচ্ছে। বিভিন্ন বিষয়ে অপপ্রচার, গুজব রটানে, আপত্তিকর – মানহানিকর, আক্রমণের উদ্যেশে ছবি ও ভিডিও পোস্ট – শেয়ার করাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে ফেসবুক এর অপব্যবহার হচ্ছে। যা সুস্পষ্টত সাইবার অপরাধ। অনেকেই কিন্তু জানেন না ফেসবুক এর সঠিক ব্যবহার। অজানা বশত কিংবা কি করা বৈধ বা কি কি করলে অবৈধ হয় সেটা না জানার কারনে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে মনের অজান্তে। ফেসবুক ব্যবহারে সাবধানতা – সতর্কতা থাকার কোনো বিকল্প নেই। একটু ভুলের কারণে আসামী হতে পারেন সাইবার অপরাধের অভিযোগে। সাইবার অপরাধীর বিচারে দেশে কঠিন আইন রয়েছে। জেনে বা না জেনে, যদি কেউ ফেসবুক ব্যবহার করতে গিয়ে কোনো অপরাধ করে তাহলে এর জন্য ভোগ করতে হবে কঠিন শাস্তি। এবং মামলাও হচ্ছে। মূলত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) অনুসরণ করা হয় সাইবার ক্রাইমের সম্পর্কিত অপরাধের জন্য।
তাই আসুন এই লেখায় জেনে নিই, কখন আর কি কি করলে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা অনলাইনে সাইবার অপরাধ হয়।
ফেসবুক ব্যবহার যখন সাইবার অপরাধ
ফেসবুক বা যেকোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা কোনো গণমাধ্যমে এমন কিছু লেখা বা পোস্ট করা বা স্ট্যাটাস দেওয়া বা মন্তব্য করা কিংবা ছবি বা ভিডিও আপলোড করা ; যা মানহানিকর, বিভ্রান্তিমূলক , অশালীন, অরূচিকর, অশ্লীল , আক্রমণাত্মক , উদ্দেশ্যে হয় তা সাইবার অপরাধ হবে।
আবার অনলাইন ব্যবহারে এমন কোনো কিছু করা যাতে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে ; লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, জাতীয়তা, যৌনতা ইত্যাদি উল্লেখ বা ইঙ্গিত করে কুৎসা রটানো কিংবা মানহানিকর, অনূভূতিতে আঘাত লাগতে পারে সবই সাইবার অপরাধ।
কোনো ব্যক্তি বা পরিবার বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে অনলাইনে ভীতি বা শক্তি প্রদর্শন করা , হুমকি দেওয়া বা কোনো কিছু পাঠানো অথবা মিথ্যা তথ্যসংবলিত বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য অপপ্রচার করলেও সাইবার অপরাধ হবে।
দেশে অরাজক ও অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করতে, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা সম্ভাবনা আছে এরকম যেকোনো কর্মকাণ্ড কিংবা দেশবিরোধী কোনো কিছু অনলাইনে করলে তাও সাইবার অপরাধ হবে।
এছাড়াও অনলাইনে কারও নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা বা হ্যাক করলে, ভাইরাস ছড়ালে, তথ্য চুরি করলে কিংবা ইলেকট্রনিক্স কোনো সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ করলে সাইবার অপরাধ হবে।
সাইবার অপরাধ হয় এরকম কোন পোস্ট বা স্ট্যাটাস বা মন্তব্য বা ছবি বা ভিডিও শেয়ার , লাইক, কিংবা ট্যাগ দিলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে।
অর্থাৎ অনলাইনে ইচ্ছাকৃতভাবে যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যা কেউ পড়িলে বা দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করাসহ সবই সাইবার অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
আইন লঙ্ঘনে বিচার প্রক্রিয়া ও শাস্তি
অনলাইন ব্যবহার করে কেউ কোন অপরাধ করলে সংক্ষুব্ধ/ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাক্তি/প্রতিষ্ঠান থানায় অভিযোগ করতে পারে। উক্ত অভিযোগ এর ভিত্তিতে অথবা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টিমের পর্যবেক্ষণে যদি অপরাধ হয়েছে বলে যুক্তিসংগত কারন থাকে তাহলে অপরাধীর বিরুদ্বে আইনগত পদক্ষেপ নিবে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করে মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করতে পারবেন। পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) ছাড়াও গ্রেপ্তার করতে পারে।এ অপরাধ কিন্তু জামিন অযোগ্য। কোনো অপরাধী, ব্যক্তি বা সংগঠনের ফেসবুক, স্কাইপ, টুইটার বা ইন্টারনেটের যেকোনো মাধ্যমের অপরাধ-সংশ্লিষ্ট আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা অথবা অপরাধ-সংশ্লিষ্ট স্থির ও ভিডিওচিত্র অপরাধের আলামত হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আদালতে উপস্থাপন করতে পারবেন। এবং আদালতে আমলযোগ্য হবে।অর্থাৎ সাক্ষ্য আইনে যাই থাকুক না কেন, মামলার স্বার্থে তা আদালতের গ্রহণযোগ্য হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) এর ৫৭ (দুই) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধ করিলে তিনি শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
ফেসবুক বর্তমানে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নানা সামাজিক প্রতিবাদে সোচ্চার কণ্ঠ হিসাবে ব্যবহার হয়েছে। বেশির ভাগ ঘটনাতেই ইতিবাচক ভূমিকায় ব্যবহার করা হয়েছে। আবার অনেক সময়ই ফেসবুক ব্যবহার করে নানা ভুল তথ্য – ছবি ও গুজব ছড়ানো হয়েছে।
মতপ্রকাশের অধিকার আছে সবার। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়। আইন মেনেই করতে হয়। অনলাইনে মতপ্রকাশের সময় এই দায়িত্ববোধ রয়েছে। সুতরাং ফেসবুক ব্যবহারে এমন সতর্কতা ও দায়িত্বশীল হতে হবে, যাতে একটি পোস্ট বা মন্তব্য যেন আইন লঙ্গন না করে। কারণ ফেসবুক কেন্দ্র করে ৫৭ ধারায় মামলা প্রচুর হয়। আসুন, ফেসবুকের যথাযথ ব্যবহার করি।
লেখক: শিক্ষানবীশ আইনজীবী, চট্টগ্রাম জজ কোর্ট। ইমেইল – ll.braihan@gmail.com