শিরোনাম
◈ জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন ◈ ইরানের ইস্পাহান ও তাব্রিজে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা, ৩টি ভূপাতিত (ভিডিও) ◈ ভেটোর তীব্র নিন্দা,মার্কিন নীতি আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লংঘন : ফিলিস্তিন ◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংসদে আইন পাশ করব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো

প্রকাশিত : ১১ আগস্ট, ২০১৮, ০৩:৫৩ রাত
আপডেট : ১১ আগস্ট, ২০১৮, ০৩:৫৩ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা

ড. ফোরকান উদ্দিন আহম্মেদ : রবীন্দ্রনাথের জীবনের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ ১৯০১ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত তিনি তার বহুবিধ কর্মতৎপরতার পাশাপাশি এ দেশের মানুষকে যথার্থ শিক্ষা দেওয়ার সংকল্পে বহু মূল্যবান সময় ব্যয় করে গিয়েছেন। প্রথমে ব্রহ্মচর্যাশ্রম এবং পরে যা বিশ্বভারতীরূপে খ্যাত হয়, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ বিশাল এক মহীরুহে পরিণত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে বিন্দুমাত্র খাপ খাওয়াতে পারেননি বলেই বিদ্যালয় জীবন অসম্পূর্ণ ছিল তার। এর দীর্ঘদিন পরে যখন নিজ সন্তানদের শিক্ষা লাভের সময় এল, তখন নতুন করে পীড়িত হলেন তিনি। আবার কি সেই পুরনো গড্ডল স্রোতেই আবর্তিত হবে সন্তানদের শিক্ষা? প্রতিবিধানের জন্য তিনি প্রাথমিকভাবে নিজেই ভার নিলেন।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তার মধ্যবর্তী করে যদি আমরা তার আজীবনের কৃতি ও সাফল্যকে পরিমাপ করে দেখি তাহলে লক্ষ করব চিত্তকে ভয়শূন্য আর শিরকে উন্নত করে রাখবার মেরুদণ্ডী প্রাণী হওয়ার সাধনাই ছিল তার কেন্দ্রস্থ অভীপ্সা, যার সঙ্গে তিনি কোনোদিনই আপোস করেননি। ঠাকুরবাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে তিনি অন্যান্য ভাইদের স্কুল কলেজে কৃতবিদ্যা হতে দেখেছেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, এমনকি পিতা দেবেন্দ্রনাথ পিতামহ দ্বারকানাথ পর্যন্ত প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যেই গড়ে উঠেন। ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার আরেক বিশেষ দিক মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দান। পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষাও কিন্তু তিনি চাইতেন ছাত্রের প্রাথমিক পর্ব থেকেই। এক পত্রে তিনি লিখেছিলেন, ‘বাল্যকাল হইতেই ইংরেজি ভাষা শিক্ষা দেওয়া হউক কিন্তু বাংলার আনুষঙ্গিক রূপে অতি অল্পে অল্পে, তাহা হইলে বাংলা শিক্ষা ইংরেজি শিক্ষায় সাহায্য করিবে।’

বাল্যকাল থেকে ইংরেজি শিক্ষা কতটা উপযোগী, এ নিয়ে নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, যখন নিবেদিতাকে তিনি তার মেয়ে মাধুরী লতাকে ইংরেজি শিক্ষাদানের জন্য নিবেদিতাকে অনুরোধ জানান। নিবেদিতা এর উত্তরে যা বলেছিলেন তা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনাকে প্রভাবিত করে থাকবে, ‘বাহির হইতে কোনো একটা শিক্ষা গলাইয়া দিয়া লাভ কী? জাতিগত নৈপুণ্য ও ব্যক্তিগত বিশেষ ক্ষমতারূপে মানুষের ভিতরে যে জিনিষটা আছে তাহাকে জাগাইয়া তোলাই আমি যথার্থ শিক্ষা মনে করি।’ এই আদর্শ প্রায় পুরোটাই অনুসৃত হতে দেখি রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মচর্য আশ্রমে, ১৯০১ থেকে। ব্রহ্মচর্যাশ্রম রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা বিষয়ক চিন্তা-ভাবনার ফলিতরূপ। তাহলে ‘শিক্ষাসত্র’ কী বস্তু আর শান্তিনিকেতনের অদূরে যে ‘শ্রীনিকেতন’ গড়ে তুললেন তিনি, সেখানেই বা প্রকল্প কী তার? মনে রাখতে হবে, তার ধ্যানে ছিল সার্বিক শিক্ষার রূপ যেখানে সৃজনশীলতা, মনুষ্যত্বের বিকাশ ও স্বাধীনতা চেতনাকে শিক্ষায় সাঙ্গীকৃত করে নেওয়ার স্বপ্ন। জীবিকার সঙ্গে শিক্ষা যেন সাজুয্য রক্ষা করে চলতে পারে। সে বিষয়ে তার মনোযোগ ছিল। টেকনোলজি শিক্ষা, বিভিন্ন বৃত্তিমুখী শিক্ষা, শিক্ষার আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে প্রকৃতি পাঠ, স্ত্রী শিক্ষা, সঙ্গীত ও চারুকলাকে শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা যেমন, তেমনি শিক্ষাদান প্রণালী নিয়েও তিনি প্রতিনিয়ত ভাবনাচিন্তা করে গিয়েছেন। শিক্ষাজীবনে বৈচিত্র্য আনবার জন্য খেলাধুলো, বনভোজন, গাছগাছালির সঙ্গে পরিচয় স্থাপন, নাটক-আবৃত্তি-নৃত্যনাট্যের ব্যবস্থা তো ছিলই, বসন্তোৎসব, বৃক্ষরোপন উৎসব, মাঘ মেলা, হলকর্ষণ, বর্ষাবরণ ইত্যাদির মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীর চেতনাকে সুন্দর, শিক্ষাকে নান্দনিকতায় উন্নীত করতে চেয়েছেন তিনি।

পরিমিত মানুষ হওয়ার অপরিমিত আকাক্সক্ষাকে জাগিয়ে রাখবার জন্যই শিক্ষা। এ লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছিল ব্রহ্মচর্যাশ্রম। এখানে যে সব অভিভাবক তাদের সন্তানদের পাঠাতেন, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শের সঙ্গে মূলগতভাবে বিরোধ ছিল তাদের। অভিভাবকেরা প্রত্যাশা করেছিলেন, আর পাঁচটা প্রতিষ্ঠানের মতো এখান থেকেও ছেলে-মেয়েরা পাস করে বেরিয়ে চাকরির গোলামীতে নাম লেখাবে। রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের উপরে এ দশটা-পাঁচটার আন্দামান চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। শিক্ষাকে বহন নয়, তার অন্বেষা ছিল শিক্ষাকে বাহন করে আরও মনুষ্যত্বের চরম উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে যাবে ছাত্ররা, যেমন গিয়েছেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, গেছেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।

এর পরবর্তী পর্ব ‘শিক্ষাসত্র’ গঠন। এই প্রতিষ্ঠানটি রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক শিক্ষা চিন্তার অঙ্গ। বিশ্বভারতীর উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে ভারতের সাথে বিশ্বের সংযোগ স্থাপন ‘শিক্ষসত্র’ উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাকে পল্লীর গভীর, গভীরতায় সঞ্চারিত করা, ১৯২৩-এর ১লা জুলাই প্রতিষ্ঠিত হল ‘শিক্ষাসত্র’। ‘শিক্ষাসত্র’ এই শ্রীনিকেতনের অন্তর্গত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

‘শিক্ষাসত্র’ কী কী বিষয় শিক্ষা দিত ছাত্রদের? রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন এখানকার শিক্ষা গ্রামজীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই পরিচালিত হবে। পুথিগত শিক্ষা থাকবে, কিন্তু পরীক্ষা ব্যবস্থা বলে কিছু থাকবে না, ১৯১৯ এ মাদ্রাজে রবীন্দ্রনাথ একটি তাৎপর্যপূর্ণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন Centre of Indian Culture নামে, যার বাস্তব রূপায়ণ-ই মনে হয় শিক্ষাসত্র। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, Our centre of culture should not only be the centre of the intellectual life of India, but the centre of her economic life also. GB economic life এর সূত্র ধরেই এখানে গোপালন, মুরগী পালন, মৎস্য চাষ, তরি-তরকারির বাগান করা একদিকে, অন্যদিকে ছাত্রাবাস চত্ত্বর নিজেরাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা। এছাড়া তাঁতের কাজ শিখত কেউ, কেউ কাঠের কেউবা মৃৎশিল্পের, চামড়ার কাজও কেউ কেউ। অবসরে হা-ডু-ডু, ফুটবল, ভলিবল ও অন্যান্য খেলা চলত। আর একটা মজার কা- করত এখানকার ছাত্ররা। পৌষমেলার একমাস আগে থেকে তারা বাঁশ, খড় ইত্যাদি দিয়ে বড় বড় তোরণ তৈরি করত রাত জেগে গান গেয়ে, হ্যাজাকের আলোয়। তাতে নন্দলাল দিতেন ফিনিশিং টাচ। ছবি আঁকাও ছিল তাদের পাঠভবনের কিশোর শিক্ষার্থীদের মত, এবং আচার্য নন্দলালের উৎসাহে তাদের ছবির সম্মিলিত প্রদর্শনীও হতো। নন্দলাল নিজে আসতে এখানকার ছাত্রদের আঁকা শেখাতে। নিজেদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী ছাড়াও নিজেদের করা হস্তশিল্পের প্রদর্শনীও হয়েছে, নিয়মিত নাটকে অভিনয় করেছে এরা।

লেখক : উপ-মহাপরিচালক ও কমান্ড্যান্ট (পিআরএল), আনসার-ভিডিপি একাডেমি, সফিপুর, গাজীপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়