আশিক রহমান : মৃত্যু সবচেয়ে সস্তা কোথায়, পৃথিবীর কোন দেশে? এরকম একটি প্রশ্ন করেছিলেন গতকাল, সমাজের খুব নামিদামি একজন মানুষ। বুদ্ধিজীবী। যিনি সমাজকে বুদ্ধি-পরামর্শ দেন, সমাজ নিয়ে চিন্তা করেন তিনিও এখন একটা ঘোরের মধ্যে আছেন! যেভাবে সড়কে মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে কখন নিজের জীবনাবসান হয়, সেই শঙ্কা তাকেও পেয়ে বসেছে। তার এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-শঙ্কা কি অমূলক? অস্বাভাবিক? না। কারণ এ মানুষটির মতো সড়কে পরিবহন শ্রমিকদের নারকীয় কর্মকাণ্ড ভীত-সন্ত্রস্ত এ ভূখণ্ডের প্রায় সব মানুষ।
চলতি বছরের ৩ এপ্রিল কারওয়ান বাজারে দুই বাস চালকের রেষারেষিতে ডান হাত হারানো তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা সমাজকে। তার আগেও এমন বহু ঘটনা ঘটেছে। পরেও ঘটেছে। ২৯ জুলাই, রোববার দুপুরের দিকে বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। তারা হলো শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব। তাদের এই অকাল মৃত্যুতে সহানুভূতি কাঙ্খিত হলেও নৌমন্ত্রী পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ নেওয়ায় ভারাক্রান্ত, একরকম অসহায় অনুভব করছে সবাই। রাষ্ট্রের একজন মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি যখন কারও অকাল, অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে পরিহাস করেন তখন কার কাছে যাবে সাধারণ মানুষ?
আরো পড়ুন : রতন সেনের খুনীদের ক্ষমা নেই, বিচার হবেই : সেলিম
বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে অনেক পরামর্শ ইতোমধ্যেই দিয়েছেন। এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের কোনো পরামর্শ রাষ্ট্র শুনেছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। কারণ দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। সড়কে মানুষ মরেই চলেছে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা তাদের মতো করেই চলছেন। আশাহীন মানুষ বাঁচে না। সমাধান চেষ্টা ছাড়াও বসে থাকার সুযোগ নেই। সড়কে কেন এমন নরক যন্ত্রণা, এর সমাধান সূত্রই-বা কী। জানতে চাইলে নগরবিশেষজ্ঞ স্থপতি অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের জাতীয় জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে সুশাসনের তীব্র অভাব রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ সবখানেই এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পরিবহন সেক্টরে সবচেয়ে মারাত্বক অবস্থা বিরাজ করছে। সুশাসন বলে কিছু নেই। আইন-কানুন মানার, মানাবার কোনো রকমের উদ্যোগ নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত উদাসীন। বাস কোম্পানি, বাস মালিক, চালক, হেলপার এরা প্রায় সবাই অশিক্ষিত বটে। এবং নিজের ভালোটাও বোঝে না। অসচেতন, আইন-কানুন মানতে উৎসাহী নয়। মানানোও হয় না। কোনো চাপও তাদের উপর নেই। রাজনৈতিক শক্তি ও প্রশাসন অত্যন্ত দুর্বল। যে কারণে সড়কে এ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
মানুষের সচেতনতার প্রশ্নটি উঠে প্রায় একই সময়ে। পথচারীরা কি যথেষ্ট সচেতন? এমন প্রশ্নও রেখেছেন এই নগরবিদ। তিনি যোগ করেন, সাধারণ মানুষও যথেষ্ট সচেতন নয়। অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয়। কিন্তু পরিবহনের ক্ষেত্রে যদি আইনশৃঙ্খলা থাকত তাহলে তারাও আইন মানতে বাধ্য হতো। জেব্রা ক্রসিং অথবা ফুটওভার ব্রিজ ছাড়া পার হতো না।
আরো পড়ুন : ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর কেনো রাস্তায় নামতে হলো?
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, আগে অমানবিক, নিষ্ঠুর আচরণ হলে সামাজিকভাবে তার জোরাল প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যেত, সেই সামাজিক শক্তিটা এখন অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। সামাজিক শক্তির সেই প্রাণচাঞ্চল্যতা আমরা এখন লক্ষ্য করি না। কেননা, দেশে আইনের শাসন সাংঘাতিক নাজুক অবস্থায় রয়েছে। আইনের শাসন এতটা নিচে নেমে গেছে যে, প্রত্যেকটি মানুষ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। আজকে সড়কে যে পরিস্থিতি, চালকদের বেপোরোয়ায় প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। কোথায় আমরা কি তার জোরাল প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-প্রতিকারের দাবি জানাচ্ছি।
মনোবিদ অধ্যাপক ডা. মো. তাজুল ইসলাম বললেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অমানবিকতার কারণ। যেখানে গাড়ি চালকদের অধিকাংশেরই অক্ষরজ্ঞান নেই, থাকলেও যথেষ্ট নয়। আবার লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় যেখানে দুর্নীতি হয় তখন সড়কের এই মৃত্যু মিছিল তো চলবেই। পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা কেন এত নিষ্ঠুর, অমানবিক মানসিকতার হয়?
আরো পড়ুন : ২০১৭ সালে বিএনপির আয় ৫ কোটি ২৬ হাজার টাকা
এই মনোবিদ আরও বলেন, সভ্যতা, মানবিকতা ও সামাজিক দায়িত্ব কি সে সম্পর্কে তাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান নেই। কাউন্সিলিংয়ে সমস্যা সমাধানের পথ খুলতে পারে। কিন্তু সেই ব্যবস্থাও তো নেই আমাদের এখানে। পরিবহন মালিকেরা এতবেশি ভোগবাদী। তারা শুধু অর্থ চায়। পরিবহনে তারা এমন সব লোকজনকে নিয়োগ দেয় তারাও কেবল শুধু টাকাই চায়। সারাদিন খেটে মনিবকে টাকা দেবে ও সেখান থেকে তারাও কিছু নেবে।
আরো পড়ুন : পুলিশ তোমরা এত্তটুকুন বাচ্চাদেরও মারো!
আপনার মতামত লিখুন :