শেখ মিরাজুল ইসলাম : ভারতে পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভায় তাদের প্রদেশের নাম বদলে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলা’ রাখার প্রস্তাব নেওয়া হলো। প্রস্তাবটি বর্তমানে কেন্দ্রে দিল্লির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। যদিও এর আগে ১৯৯৯ সালে সাবেক মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রস্তাব রেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বাস্তবতায় পূর্ববঙ্গের যেহেতু কোনো অস্তিত্ব নেই তাই পশ্চিমবঙ্গের নামও পরিবর্তন করা হোক। মমতা ব্যানার্জির সরকারের উদ্যাগে নেওয়া এই নাম পরিবর্তনকে অনেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলছেন। পরিবর্তিত প্রদেশের নামের ইংরেজিতে আদ্যক্ষর ‘বি’ থাকলে কেন্দ্রে সভার শুরুতেই কথা বলা যাবে যুক্তিটি তারা তুলে ধরছেন। কিন্তু লোকসভায় কোন প্রদেশ আগে কথা বলবে এই অভ্যন্তরীণ ইস্যুটি সমাধানের অজুহাতে বাংলাদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নাম পরিবর্তন ইঙ্গিতপূর্ণ। আগামী মাসে যদি দিল্লির লোকসভায় এই বিলটি রাজনৈতিক বিবেচনায় এনে পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ রাখা হয়, তবে সেটা হবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য অস্বস্তিদায়ক। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একই সীমান্তের এপার-ওপারে থাকা একটি স্বাধীন দেশ ও একটি প্রদেশের নামের মধ্যে মিল থাকলে পদে পদে নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।
যদিও আমাদের আম জনতা এখনো এই ইস্যুটার গুরুত্ব ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছেন না, অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ তাদের ‘টিএসসি’র চুম্বন দৃশ্যের মতো তা ধরিয়েও দিচ্ছেন না। অথবা এমন হতে পারে এই ব্যাপারে তর্ক-বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার আগে যে যার অবস্থান থেকে এখনো জ্ঞান অর্জনে করে চলেছেন। আপাতত কয়েকটি স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে। আমাদের অতি পরিচিত কিছু দেশাত্মবোধক গানের দ্যোতনার অন্তর্নিহিত চেতনা অদূর ভবিষ্যতে সাংঘর্ষিক হতে পারে দুই বাংলার নামের জেরে। জাতীয় সঙ্গীত নিয়েও একই ভাবনা প্রযোজ্য। ধরুন, কলকাতার ইডেন গার্ডেনে কোনো এক আন্তর্জাতিক ইভেন্টে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। স্টেডিয়ামে উপস্থিত ওই বাংলার দর্শকরা পরাবাস্তব জাতীয় একাত্মতা কি বোধ করবেন না? ভাষাগত সমিলতার কারণে সোনার বাংলার স্বপ্ন তো তারাও দেখে। কিংবা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘ও আমার বাংলা মা গো’, ‘বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা’ ইত্যাদি গানগুলোর কথা ও সুরের চেতনা নব্য ‘বাংলা’ প্রদেশের মননের সঙ্গে দ্রবীভ‚ত হবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?
বাংলা নামের দেশ তো শুধু আমাদেরই আছে। দেশের সার্বভৌমত্ব এই নামের সঙ্গে সম্পূরক। ওপার বাংলার কারও ভুলে বাংলাদেশের নামে কোনো বাজে ইঙ্গিত করলে আমাদের দেশপ্রেমের ইজ্জতে আঘাত লাগে। এখন বহির্বিশ্বে ‘বাংলা’ নামের প্রদেশের সঙ্গে সুনাম-দুর্নাম ভাগাভাগি করতে হবে। এখন নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলের বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মতো পৃথক পৃথক অঞ্চলভিত্তিক জাতিতাত্তি¡ক অধিকার স্বনামে প্রতিষ্ঠিত করার এই ক‚টকৌশল আমাদের ধীমান বুদ্ধিজীবী রাষ্ট্রপক্ষ কি বোঝেও বুঝল না? ভীষণ সূক্ষ কারসাজির এই বাংলা নামকরণ হয়ে গেলে আর ফেরার উপায় নেই।
দুই দেশের মানুষ অভিন্ন বাংলা ভাষায় কথা বললেও নব্য প্রস্তাবিত বাংলা আর স্বাধীন বাংলাদেশ দুটো আলাদা অস্তিত্ব ধারণ করে আসছে। নামের সাদৃশ্যে দ্ব›দ্ব এখন বাড়বে বৈ কমবে না। এর পেছনে গভীর সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। ইতিহাসে এমন উদহারণ আছে। যেমন একই ভাষায় কথা বললেও ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড ভিন্ন জাতিসত্তা ধারণ করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ লড়াই চালিয়ে গেছে। এই স্বকীয়তা বোধের দায়বদ্ধতা আমাদের আগে প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল না। এখন মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেরী না করে আমাদের সরকার ও বিজ্ঞ সুশীল সমাজের উচিত এই বিষয়ে সরাসরি দিল্লির সঙ্গে কথা বলা। না হলে ইতিহাসে প্রমাণিত হবে বলিহারি বুদ্ধি মমতা দিদি মনির!
লেখক : চিকিৎসক ও লেখক
আপনার মতামত লিখুন :